পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ ○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী কাপড় বানাইয়া লও। সে তুমি নিজের দেশ, নিজের পরিবেশ, নিজের পূর্বাপরের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া প্রস্তুত করো। সম্পূর্ণ ইতিহাসবিরুদ্ধ ভাববিরুদ্ধ সংগতিবিরুদ্ধ অনুকরণের প্রতি হতবুদ্ধির ন্যায় ধাবিত হইয়ো না । 品 পুরাতনের পরিবর্তন ও নূতনের নির্মাণে দোষ নাই। আবশ্যকের অনুরোধে তাহা সকল জাতিকেই সর্বদা করিতে হয়। কিন্তু এরূপ স্থলে সম্পূর্ণ অনুকরণ প্রয়োজনের দোহাই দিয়া চলে না। সে প্রয়োজনের দোহাই একটা ছুতামাত্র। কারণ সম্পূর্ণ অনুকরণ কখনােই সম্পূর্ণ উপযোগী হইতে পারে না । তাহার হয়তো একাংশ কাজের হইতে পারে, অপরাংশ বাহুল্য । তাহার ছাটা কোর্তা হয়তো দৌড়াধাপের পক্ষে প্রয়োজনীয় হইতে পারে, কিন্তু তাহার ওয়েস্টকোট হয়তো ব্যক এবং উত্তাপজনক। তাহার টুপিটা হয়তো খপ করিয়া মাথায় পরা সহজ হইতে পারে, কিন্তু তাহার টাই-কলার বাধিতে অনর্থক সময় দিতে হয় । যেখানে পরিবর্তন ও নূতন নির্মাণ অসম্ভব ও সাধ্যাতীত, সেইখানেই অনুকরণ মার্জনীয় হইতে পারে। বেশভূষায় সে-কথা কোনোক্রমেই খাটে না । বিশেষত বেশভূষায় কেবলমাত্র অঙ্গাবরণের প্রয়োজন সাধন করে না, তাহাতে ভদ্রাভদ্ৰ, দেশী-বিদেশী, স্বজাতি-বিজাতির পরিচয় দেওয়া হয় । ইংরেজি কাপড়ের ভদ্রতা ইংরেজ জানে । আমাদের ভদ্রলোকদের অধিকাংশের তাহা জানিবার সম্ভাবনা নাই । জানিতে গেলেও সর্বদাই ভয়ে ভয়ে পরের মুখ তাকাইতে হয় । - তার পরে স্বজাতি-বিজাতির কথা । কেহ কেহ বলেন, স্বজাতির পরিচয় লুকাইবার জন্যই বিলাতি কাপড়ের প্রয়োজন হয় । । এ কথা বলিতে যাহার লজাবোধ না হয়, তাহাকে লজা দেওয়া কাহারও সাধ্য নহে, পরের বাড়িতে ছদ্মবেশে সম্বন্ধী সাজিয়া গেলে আদর পাওয়া যাইতে পারে, তবু যাহার কিছুমাত্র তেজ ও ভদ্রতাজ্ঞান আছে, সেই আদরকে সে উপেক্ষা করিয়া থাকে। রেলওয়ের ফিরিঙ্গি গার্ড ফিরিঙ্গিভ্রাতা মনে করিয়া যে-আদর করে তাহার প্রলোভন সংবরণ করাই ভালো । কোনো কোনো রেল-লাইনে সেজন্য রাগিয়া কষ্ট পাইবার অবসর যদি হাতে থাকে। তবে সে-কষ্ট স্বীকার করো, কিন্তু জন্ম ভাড়াইয়া সেই গাড়িতে বা সেই হােটেলে প্ৰবেশ করিলে সম্মানের যে কী বৃদ্ধি হয়, তাহা বুঝা কঠিন । পরিবর্তন কোন পর্যন্ত গেলে অনুকরণের সীমার মধ্যে আসিয়া পড়ে, তাহা নির্দিষ্ট করিয়া বলা শক্ত । তবে সাধারণ নিয়মের স্বরূপ একটা কথা বলা যাইতে পারে । যেটুকু লইলে বাকিটুকুর সহিত বেখাপ হয় না, তাহাকে বলে গ্ৰহণ করা ; যেটুকু লইলে বাকিটুকুর সহিত অসামঞ্জস্য হয় তাহাকে বলে অনুকরণ করা । মোজা পরিলে কোট পরা অনিবাৰ্য হয় না, ধুতির সঙ্গে মোজা বিকল্পে চলিয়া যায়। কিন্তু কোটের সঙ্গে ধুতি, অথবা হ্যাটের সঙ্গে চাপকন চলে না। সাধু ইংরেজিভাষার মধ্যেও মাঝে মাঝে ফরাসি মিশাল চলে, তাহা ইংরেজি-পাঠকেরা জানেন । কিন্তু কী-পর্যন্ত চলিতে পারে, নিশ্চয়ই তাহার একটা অলিখিত নিয়ম আছে, সে-নিয়ম বুদ্ধিমান ব্যক্তিকে শেখানো বাহুল্য। তথাপি তার্কিক বলিতে পারে, তুমি যদি অতটা দূরে গেলে, আমি না-হয় আরো কিছুদূর গেলাম, কে আমাকে নিবারণ করবে। সে তো ঠিক কথা । তোমার রুচি যদি তোমাকে নিবারণ না করে, তবে কাহার পিতৃপুরুষের সাধ্য তোমাকে নিবারণ করিয়া রাখে । বেশভূষাতেও সেই তর্ক চলে। যিনি আগাগোড়া বিলাতি ধরিয়াছেন তিনি সমালোচককে বলেন, তুমি কোন চাপিকানের সঙ্গে প্যান্টলুন পরিয়াছ। অবশেষে তর্কটা ঝগড়ায় গিয়া দাড়ায় । সে স্থলে আমার বক্তব্য এই যে, যদি অন্যায় হইয়া থাকে, নিন্দা করো, সংশোধন করো, প্যান্টালুনের পরিবর্তে অন্য কোনোপ্রকার পায়জামা যদি কার্যকর ও সুসংগত হয় তবে তাহার প্রবর্তন করে- তাই বলিয়া-তুমি আগাগোড়া দেশীবন্ত্র পরিহার করিবে কেন। একজন এক কান কাটিয়াছে বলিয়া দ্বিতীয়