পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব \bՕԳ চাহিয়া দেখি- গোটাদশেক হলদে রঙ-করা মস্ত-খোপাবিশিষ্ট মাটির পুতুল তাঁহাদের হস্তদ্বয়ের অসম্পূর্ণতা ও পদদ্বয়ের সম্পূর্ণ অভাব লইয়া অম্লান বদনে আমার বাক্সর মধ্যে অন্তঃপুর রচনা করিয়া বসিয়া আছে । আমার কাগজপত্র কোথায় । কোথাও নাই। একটি বালিকা আমার হিজিবিজি কাগজগুলি বিষম। ঘূণাভরে ফেলিয়া দিয়া বাক্সটির মধ্যে পরম সমাদরে তাহার পুতুলের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। তাহাদের বিছানাপত্র, তাহাদের কাপড়চােপড়, তাহাদের ঘটিবাটি, তাহাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সামান্যতম উপকরণটুকু পর্যন্ত কিছুরই ত্রুটি দেখিলাম না, কেবল আমার কাগজগুলিই নাই। বুড়ার খেলা বুড়ার পুতুলের জায়গা ছেলের খেলা ছেলের পুতুল অধিকার করিয়া বসিল । প্রত্যেক বৈয়াকরণের ঘরে এমনই একটি করিয়া মেয়ে থাকে যদি, পৃথিবী হইতে সে যদি তদ্ধিত প্রত্যয় ঘুচাইয়া তাহার স্থানে এইরূপ ঘোরতর পৌত্তলিকতা প্রচার করিতে পারে, তবে শিশুদের পক্ষে পৃথিবী অনেকটা নিষ্কণ্টক হইয়া যায় । কিছু কিছু মনে আছে, তাহা লিখিতেছি— অ কিংবা অকারান্ত বর্ণ উচ্চারণকালে মাঝে মাঝে ও কিংবা ওকারান্ত হইয়া যায় । যেমন : অতি কলু ঘড়ি কল্য মরু দক্ষ ইত্যাদি । এরূপ স্থানে আ যে ও হইয়া যায়, তাহাকে হ্রস্ব-ও বলিলেও হয় । দেখা গিয়াছে অ কেবল স্থানবিশেষেই ও হইয়া যায়, সুতরাং ইহার একটা নিয়ম পাওয়া যায়। ১ম নিয়ম । ই (হ্রস্ব অথবা দীর্ঘ) অথবা উ (হ্রস্ব অথবা দীর্ঘ) কিংবা ইকারান্ত উকারান্ত ব্যঞ্জনবর্ণ মুক্তি তাহার পূর্ববর্তী আকারের উচ্চারণ ও হুইবে যথা, অগ্নি অত্ৰিম কপি তরু অঙ্গুলি অঞ্চল २ ২য় । যফলা-বিশিষ্ট ব্যঞ্জনবর্ণ পরে থাকিলে “অ’ ‘ও’ হইয়া যাইবে । এ নিয়ম প্রথম নিয়মের অন্তৰ্গত বলিলেও হয়, কারণ যফলা ই এবং অ-এর যোগমাত্র । উদাহরণ, গণ্য দন্ত্য লভ্য ইত্যাদি । 'দন্ত এবং ‘দন্ত্য না। এই দুই শব্দের উচ্চারণের প্রভেদ লক্ষ্য করিয়া দেখো । ৩য়। ক্ষ পরে থাকিলে তৎপূর্ববর্ত ‘অ’ ‘ও’ হইয়া যায় ; যথা, অক্ষর কক্ষ লক্ষ পক্ষ ইত্যাদি । ক্ষা-র উচ্চারণ বোধ করি এককালে কতকটা ইকার-ঘেঁষা ছিল, তাই এই অক্ষরের নাম হইয়াছে ক্ষিয় । পূর্ববঙ্গের লোকেরা এই ক্ষ-র সঙ্গে যফলা যোগ করিয়া উচ্চারণ করেন, এমন-কি, ক্ষা-র পূর্বেও ঈষৎ ইকারের আভাস দেন । কলিকাতা অঞ্চলে “লক্ষ টাকা” বলে, তাহারা বলেন ‘লৈক্ষ্য টাকা” । ৪র্থ। ক্রিয়াপদে স্থলবিশেষে অকারের উচ্চারণ ‘ও’ হইয়া যায় ; যেমন, হ’লে করলে প’ল মল ইত্যাদি । অর্থাৎ যদি কোনো স্থলে অ-এর পরবর্তী ই অপভ্রংশে লোপ হইয়া থাকে, তথাপিও পূর্ববর্তী অ-এর উচ্চারণ ও হইবে । হইলে-র অপভ্রংশ হ’লে, করিলে-র অপভ্রংশ করলে, পড়িল-পাল, মরিল-মল | করিয়া-র অপভ্ৰংশ করে, এইজন্য ক-এ ওকার যোগ হয়, কিন্তু সমাপিকা ক্রিয়া করে” অবিকৃত থাকে । কারণ করে শব্দের মধ্যে ই নাই এবং ছিল না । । ৫ম । ঋফলা-বিশিষ্ট বর্ণ পরে আসিলে তৎপূর্বের আকার ‘ও’ হয় ; যথা, কর্তৃক ভর্তু মসৃণ যকৃত বক্তৃতা ইত্যাদি । ইহার কারণ স্পষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে, বঙ্গভাষায় ঋফলার উচ্চারণের সহিত ইকারের যোগ আছে। ৬ষ্ঠ । এবারে যে-নিয়মের উল্লেখ করিতেছি তাহা নিয়ম কি নিয়মের ব্যতিক্রম বুঝা যায় না । দ্ব্যক্ষর-বিশিষ্ট শব্দে দন্ত্য ন অথবা মূর্ধন্য ণ পরে থাকিলে পূর্ববর্তী অকার ‘ও’ হইয়া যায় ; যথা, বন ধন জন মন মণ পণ ক্ষণ ।। ঘন শব্দের উচ্চারণের স্থিরতা নাই । কেহ বলেন “ঘনো দুধ, কেহ বলেন ঘোনো দুধ’ । কেবল গণ এবং রণ শব্দ এই নিয়মের মধ্যে পড়ে না। তিন অথবা, তাহার বেশি । অক্ষরের শব্দে এই নিয়ম খাটে না ; যেমন, কনক গণক সনসন কনকন। তিন অক্ষরের অপভ্রংশে যেখানে দুই অক্ষর হইয়াছে, সেখানেও এ নিয়ম খাটে না ; যেমন, কহেন শব্দের অপভ্রংশ কন, হয়েন শব্দের অপভ্রংশ হন ইত্যাদি। যাহা হউক ষষ্ঠ নিয়মটা তেমন পাকা নহে। ] ৭ম । ৪র্থ নিয়মে বলিয়াছি অপভ্রংশে ইকারের লোপ হইলেও পূর্ববতী অ‘ও’ হইয়াছে। অপভ্রংশে