পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব VVS করিয়া, খুরথুর করিয়া, খুটুস খুটুস করিয়া, গুটিগুটি করিয়া, ঘটর ঘটর করিয়া, ট্যাঙস ট্যাঙস করিয়া, থপা থপি করিয়া, থাপাস থাপাস করিয়া, ধদ্ধড় করিয়া, ধা ধা করিয়া, সন সন করিয়া, সুড় সুড় করিয়া, সুট সুট করিয়া, সুড়ৎ করিয়া, হন হন করিয়া, হুড়মুড় করিয়া- চলার এত বিচিত্র অথচ সুস্পষ্ট ছবি কোথায় পাওয়া যাইবে । চলা কাটা প্রভৃতি ক্রিয়ার সহিত ধ্বনির সম্বন্ধ থাকা আশ্চর্য নহে; কারণ গতি হইতে শব্দ উৎপন্ন হইয়া থাকে। কিন্তু যে-সকল ছবি ধ্বনির সহিত দূরসম্পর্কবিশিষ্ট, তাহাও বাংলাভাষায় ধ্বনাত্মক শব্দে ব্যক্ত হয় ; যেমন পাতলা জিনিসকে ফিনফিন ফুরফুর ধ্বনির দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। পাতলা ফিনফিন করছে, বলিলে এ কথা কেহ বোঝে না যে, পাতলা বস্তু বাস্তবিক কোনো শব্দ করিতেছে, অথচ তদ্দ্বারা তনু পদার্থের তনুত্ব সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। ছিপছিপে কথাটাও ঐরূপ ; সরু বেতই বাতাসে আহত হইয়া ছিপছিপ শব্দ করে, মোটা লাঠি করে না, এইজন্য ছিপছিপে লোক বস্তুত কোনো শব্দ না করিলেও ছিপছিপে শব্দ দ্বারা তাহার দেহের বিরলতা সহজেই মনে আসে। লকলকে লিকলিকে লিংলিঙে শব্দও এই শ্রেণীর । কিন্তু ধ্বনির সহিত যে-সকল ভাবের দূর সম্বন্ধও নাই, তাহাও বাংলায় ধ্বনির দ্বারা ব্যক্ত হয় । যেমন কনকনে শীত ; কনকন ধ্বনির সহিত শীতের কোনো সম্বন্ধ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না । শীতে শরীরে যে বেদনা বোধ হয়, আমাদের কল্পনার কোনাে অদ্ভুত বিশেষত্ববশত আমরা তাহাকে কনকন ধ্বনির সহিত তুলনা করি ; অর্থাৎ আমরা মনে করি, সেই বেদনা। যদি শ্রুতিগম্য হইত। তবে তাহা আমরা শরীরের প্রায় সর্বপ্রকার বেদনাকেই বিশেষ বিশেষ ধবনির ভাষায় ব্যক্ত করি ; যথা, কটকট কনকন করকর (চোখের বালি) কুটকুট গা-ঘ্যানঘ্যান (বা গা-ঘিনীঘিন) গা-চচ্চড় চিনচিন গা-ছিমছম ঝিনঝিন দবদব ধকধক বুক-দুন্দুড় ম্যাজম্যাজ সুড়সুড়ি সড়সড় রক্টরী । ইংরেজিতে এইরূপ শারীরিক (MP301CS-throbbing gnawing boring crawling cutting tearing bursting 2"f বিশেষণে অভিহিত করা হয়। আমরাও ছিড়ে পড়া, ফেটে যাওয়া, কামড়ানো প্রভৃতি বিশেষণ আবশ্যকমত ব্যবহার করি, কিন্তু উল্লিখিত ধ্বন্যাত্মিক শব্দে তাহা যে ভাবে ব্যক্ত হয়, তাহা আর কিছুতে হইবার জো নাই। ঐ-সকল ধ্বনির সহিত ঐ-সকল বেদনার সম্বন্ধ যে কাল্পনিক, এক্ষণে আমাদের পক্ষে তাহা মনে করাই কঠিন। বাস্তবিক অনুভূতি সম্বন্ধে কিরূপ বিসদৃশ উপমা আমাদের মনে উদিত হয়, গা মাটিমাটি করা, বাক্যটি তাহার উদাহরণস্থল। মাটির সহিত শারীরিক অবস্থাবিশেষের যে কী তুলনা হইতে পারে তাহা বুঝা যায় না, অথচ, গা মাটিমাটি করা, কথাটা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট ভাববহ । ] সর্বপ্রকার শূন্যতা, স্তব্ধতা, এমন-কি, নিঃশব্দতাকেও আমরা ধ্বনির দ্বারা ব্যক্ত করি। আমাদের ভাষায় শূন্য ঘর খা খ্যা করে, মধ্যাহ্ন রৌদ্রের স্তব্ধতা বা ঝা করে, শূন্য মাঠ ধুধু করে,বৃহৎ জলাশয় থৈ থৈ করে, পোড়োবাড়ি হাঁ হী করে, শূন্য হৃদয় হু হু করে, কোথাও কেহ না থাকিলে ভো ভো করিতে থাকে- এই সকল নিঃশব্দতার ধ্বনি অন্যভাষীদের নিকট কিরূপ জানি না, আমাদের কাছে নিরতিশয় স্পষ্ট ভাববাহ ; ইংরেজি ভাষার desolate প্রভৃতি অর্থাত্মক শব্দ, অন্তত আমাদের নিকট এত সুস্পষ্ট নহে । বৰ্ণকে ধ্বনিরূপে বর্ণনা করা, সেও আশ্চর্য । টকটকে টুকটুকে ডগডগে দগদগে রগরগে লাল ; ফুটফুটে ফ্যাটফোটে ফ্যাকফেকে ধবধবে সাদা ; মিসমিসে কুচকুচে কালো । টকটক শব্দ কাঠের ন্যায় কঠিন পদার্থের শব্দ । যে-লাল অত্যন্ত কড়া লাল সে যখন চক্ষুতে আঘাত করে, তখন সেই আঘাতক্রিয়ার সহিত টিকটক শব্দ আমাদের মনে উহ্য থাকিয়া যায়। কবির কৰ্ণে যেমন ‘silent spheres, অর্থাৎ নিঃশব্দ জ্যোতিষ্কলোকের একটি সংগীত উহ্যভাবে ধ্বনিত হইতে থাকে, এও সেইরূপ । ঘোর লাল আমাদের ইন্দ্ৰিয়দ্বারে যে-আঘাত করে, তাহার যদি কোনো শব্দ থাকিত, তবে তাহা আমাদের মতে টকটক শব্দ। আবার সেই রক্তবর্ণ যখন মৃদুতর হইয়া আঘাত