পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব • \986 আনন্দ কৌতুক ও বিদ্রুপ প্রকাশ করে ; বাংলাভাষা খলখল করিয়া, খিলখিল করিয়া, হােহাে করিয়া, হিহি। করিয়া, ফিক ফিক করিয়া, ফিক করিয়া এবং মুচুকিয়া হাসে । মুচকে হাসির জন্য বাংলা অমরকোষের কাছে ঋণী নহে। মাচুকান শব্দের অর্থ বাকান, বাকাইতে গেলে যে মাচু করিয়া ধ্বনি হয় সেই ধ্বনি হইতে এই কথার উৎপত্তি । উহাতে হাসিকে ওষ্ঠাধরের মধ্যে চাপিয়া মাচকাইয়া রাখিলে তাহা মুচকে হাসিরূপে একটু বাকাভাবে বিরাজ করে । * বাংলাভাষার এই শব্দগুলি প্রায়ই জোড়াশব্দ । এগুলি জোড়া শব্দ হইবার কারণ আছে। জোড়া শব্দে একটা কালব্যাপকত্বের ভাব আছে। ধুধু করিতেছে। ধবধব করিতেছে, বলিতে অনেকক্ষণ ধরিয়া একটা ক্রিয়ার ব্যাপকত্ব বোঝায়। যেখানে ক্ষণিকতা বোঝায়। সেখানে জোড়া কথার চল নাই ; যেমন, ধা করিয়া, সঁা করিয়া ইত্যাদি । যখন ধা। ধা, সঁা সঁা, বলা যায় তখন ক্রিয়ার পুনরাবর্তন বুঝায়। ‘এ’ প্ৰত্যয় যোগ করিয়া এই-জাতীয় শব্দগুলি হইতে বিশেষণ তৈরি হইয়া থাকে ; যেমন, ধবধবে টকটকে ইত্যাদি । টকটক ঠকঠক প্রভৃতি কয়েকটি ধ্বন্যাত্মিক শব্দের মাঝখানে আকার যোগ করিয়া উহারই মধ্যে একটুখানি অর্থের বিশেষত্ব ঘটানো হইয়া থাকে ; যেমন, কচকচ কটাকটি কড়াক্কড় কপােকপ খচখচ খটখট খপাখপ গপগপ ঝনাজাঝন টকাটক টপটপ ঠকাঠক ধড়ান্ধবড় ধপধপি, ধামাধবম পটাপট ফসাফস । কপকপ এবং কপাকপা, ফসফস এবং ফসফাস, টপটপ এবং টপটপ শব্দের মধ্যে কেবলমাত্র আকারযোগে অর্থের যে সূক্ষ্ম বৈলক্ষণ্য হইয়াছে, তাহা কোনো বিদেশীকে অর্থবিশিষ্ট ভাষার সাহায্যে বোঝানো শক্ত । ঠকাঠক বলিলে এই বুঝায় যে, একবার ঠিক করিয়া তাহার পরে বলসঞ্চয়পূর্বক পুনর্বার দ্বিতীয়বার ঠিক করা ; মাঝখানের সেই উদ্যত অবস্থার যতিটুকু আকার যোগে আপনাকে প্রকাশ করে । এইরূপে বাংলাভাষা যেন অ আ ই উ স্বরবর্ণ কয়টাকে লইয়া “সুরের মতো ব্যবহার করিয়াছে। সে-সুর যাহার কানে অভ্যস্ত হইয়াছে সে-ই তাহার সূক্ষ্মতম মর্মটুকু বুঝিতে পারে। উল্লিখিত উদাহরণগুলিতে লক্ষ করিবার বিষয় আর-একটি আছে। আদ্যক্ষরে যেখানে অকার আছে সেইখানে পরবতী অক্ষরে আকার-যোজন চলে, অন্যত্র নহে। যেমন টকটক হইতে টকাটক হইয়াছে, কিন্তু টিকটিক হইতে টিকাটিক বা ঠকঠক হইতে ঠকাঠক হয় না । এইরূপে মনোযোগ করিলে দেখা যাইবে, বাংলাভাষার উচ্চারণে স্বরবর্ণগুলির কতকগুলি কঠিন বিধি আছে। স্বরবর্ণ আকারকে আবার আর-এক জায়গায় প্রয়োগ করিলে আর-একরকমের সুর বাহির হয় ; তাহার দৃষ্টান্ত, টুকটাক ঠকঠাক খুঁটিখাট ভুটভাট দুড়দাড় কুপকাপ গুপগাপ বুপকাপ টুপটাপ ধুপ ধাপ হুপহাপ দুমদাম ধুমধাম ফুসফাস হুসাহাস । , এই শব্দগুলি দুই প্রকারের ধ্বনিব্যঞ্জন করে, একটি অস্ফুট আর-একটি স্ফুট । যখন বলি, টুপটাপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছে তখন এই বুঝায় যে, ছোটাে ফোটাটি টুপ করিয়া এবং বড়ো ফোটাটি টাপ করিয়া পড়িতেছে, ঠিকঠাক শব্দের অর্থ একটা শব্দ ছোটাে আর-একটা বড়ো। উকারে অব্যক্তপ্রায় প্রকাশ, আকারে পরিস্ফুট প্রকাশ । 重 আমরা এতক্ষণ যে-সকল জোড়া কথার দৃষ্টান্ত লইয়া আলোচনা করিলাম তাহারা বিশুদ্ধ ধ্বন্যাত্মক। আর-একরকমের জোড়াকথা আছে তাহার মূলশব্দটি অর্থসূচক এবং দোসর শব্দটি মূলশব্দেরই অর্থহীন বিকার ; যেমন, চুপচাপ ঘুষঘাষ তুকতাক ইত্যাদি । চুপি ঘুষ এবং তুক এ-তিনটে শব্দ আভিধানিক, ইহারা অর্থহীন ধ্বনি নহে ; ইহাদের সঙ্গে চাপ ঘাষ ও তাক, এই তিনটে অর্থহীন শব্দ । শুদ্ধমাত্র ইঙ্গিতের কাজ করিতেছে। জলের ধারেই যে-গাছটা দাড়াইয়া আছে সেই গাছটার সঙ্গে সঙ্গে তাহার সংলগ্ন বিকৃত ছায়াটাকে একত্র করিয়া দেখিলে যেমন হয়, বাংলাভাষার এই কথাগুলাও সেইরূপ : চুপ কথাটার সঙ্গে তাহার