পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬৫৬ ৷ রবীন্দ্র-রচনাবলী সর্বাপেক্ষা অধিক সন্দেহ করেন। সেইগুলিই তাহারা সর্বাপেক্ষা অধিক উৎসাহের সহিত ঘোষণা করেন, কারণ বিরোধী পক্ষ সেইগুলিকেই অধিকতর অবিশ্বাস করিয়া থাকে। ক্রমে এতদূর পর্যন্ত হইতে পারে যে, যাহা নৈতিক দুৰ্দশার কারণ তাহাকেই তাহারা স্বগীয় বলিয়া প্রচার করেন, অথচ ইহার অসংগতি নিজেই মনে মনে না বুঝিয়া থাকিতে পারেন না। প্ৰথমে অল্পে অল্পে চোখ ফুটিতে থাকে এবং জোর করিয়া নিজ মত সমর্থন করেন, পরে ক্ৰমে আপন মত অন্যায় জানিয়াও স্পষ্ট কাপট্য অবলম্বন করেন । অধ্যাপক সীলির এই বর্ণনার সহিত আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থার কী আশ্চর্য ঐক্য । নুতন শিক্ষাপ্রাপ্ত বঙ্গভূমির নূতন চিন্তাম্রোত ও জীবনস্রোতের সহিত প্রাচীন সমাজতন্ত্র মিশিতে পারিতেছে না । সুতরাং প্রাচীন সমাজের প্রচলিত বিশ্বাস বলে যে-সকল বৃহৎকার্য যেরূপ প্রবল বেগে সম্পন্ন হইতে পারিত, এখন আর সেরূপ হইবার সম্ভাবনা নাই। তখনকার জীবন্ত বিশ্বাস এখন জীবনহীন প্রথায় পরিণত হইয়াছে । অবসাদ অশান্তি ও সংশয়ে আমাদের সমাজ ভারাক্রান্ত, এবং আমাদের মধ্যে একদল লোক উঠিয়াছেন, তাহারা পরমসূক্ষ্ম কুটযুক্তি দ্বারা প্রাচীন মতের পক্ষ সমর্থন করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন ; এবং বোধ করি একদল রূঢ়স্বভাব সংবাদপত্রব্যবসায়ীর মধ্যে এ সম্বন্ধে কাপট্যের লক্ষণও দেখা দিয়াছে । সম্প্রতি আমাদের দেশে একদলের মধ্যে এই-যে প্ৰাচীনতার একান্ত পক্ষপাত দেখা যায়, তাহার কতকগুলি কারণ ঘটিয়াছে। প্রথমত, নূতন শিক্ষার প্রভাবে আমরা অনেকগুলি নুতন কর্তব্য প্রাপ্ত হইয়াছি ; কিন্তু আমাদের অনভ্যাস, পূর্বরাগ, স্বাভাবিক জড়ত্ব ও ভীরুতাবশত আমরা তাহা সমস্ত পালন করিয়া উঠিতে পারি না । আলস্যের দায়ে ও সমাজের ভয়ে অনেক সময়ে আমরা তাহার বিপরীতচরণ করিয়া থাকি । কিন্তু অসম্পন্ন কর্তব্যের লাঞ্ছনা মানুষ চিরদিন সহিয়া থাকিতে পারে না। কেন বিশ্বাস করিতেছি একরূপ এবং কাজ করিতেছি। অন্যরূপ, তাহার সন্তোষজনক কৈফিয়ত দিতে ইচ্ছা করে । সুতরাং কিছুদিন পরে নূতন বিশ্বাসের খুঁত ধরিতে আরম্ভ করা যায়। নূতন শিক্ষালব্ধ কর্তব্য যে অকর্তব্য, এবং আমরা যাহা করিয়া আসিতেছি ঠিক তাহাই করা যে উচিত, প্ৰাণপণ সূক্ষ্মযুক্তি দ্বারা ইহাই প্রমাণ করিতে প্ৰবৃত্ত হওয়া যায়। কিন্তু এরূপ স্থলে সাধারণত যুক্তিগুলি কিঞ্চিৎ অতিরিক্ত সূক্ষ্ম হইয়া পড়ে ; এত সূক্ষ্ম হয় যে সেই যুক্তিভেদ করিয়া যুক্তিকর্তার হৃদয়ের প্রচ্ছন্ন অবিশ্বাস কখনো কখনো কিছু কিছু দৃষ্টিগোচর হইতে থাকে । , দ্বিতীয়ত, পুরাতনের উপর যখন একবার আমাদের বিশ্বাস শিথিল হইয়া যায়, তখন আমরা অনেক সময় অবিচারে নূতনকে হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশাধিকার দিই। নূতনের উপর প্রকৃত বিশ্বাসবশতই যে তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া আনি । আমরা গৃহশিক্রর প্রতি আড়ি করিয়া কখনাে কখনাে বহিঃশত্রুকে গৃহে আহবান করিয়া থাকি । অবশেষে উপদ্রব সহ্য করিয়া যখন চৈতন্য হয় তখন আগাগোড়া নূতনের উপরে বিরাগ জন্মে। যখন এ দেশে নুতন কলেজ হয় তখন শিক্ষিত যুবকেরা যে অনেকগুলি উৎপাত আপন গৃহচালের উপরে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন, সে কেবল পুরাতনের উপরে আড়ি করিয়া বৈ তো, নয়। এখনকার একদল লোক সেই সকল উৎপাতমিশ্রিত নূতন মতকে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য বলিয়া প্রমাণ করিবার জন্য কৃতসংকল্প হইয়াছেন। তৃতীয়ত, আমরা পরাধীন জাতি । আমরা পরের কাছে অপমানিত, সুতরাং ঘরে সম্মানের প্রত্যাশী । এইজন্য আমরা ইংরেজকে বলিতে চাহি- ইংরেজ, তোমাদের শস্ত্ৰ বড়ো, কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰ বড়ো ; তোমরা রাজা, আমরা আর্য। এককালে আমাদের যাহা ছিল এখনো যেন তাঁহাই আছে, এইরূপ ভান করিয়া অপমানদুঃখ ভুলিয়া থাকিতে চাই। দেহে বল ও হৃদয়ের সাহস নাই যে অপমান হইতে আপনাকে রক্ষা করিতে পারি, সুতরাং পুরাণ ও সংহিতা, চটুল রসনা ও কূটযুক্তির দ্বারা আবৃত হইয়া আপনাকে বড়ো বলিয়া মনে করিতে ইচ্ছা হয় । যে-সকল আচারের অস্তিত্ব হয়তো আমাদের অপমানের অন্যতম কারণ সেগুলি দূর করিতে সাহস হয় না, এইজন্য তাঁহাদের প্রতি আৰ্য আধ্যাত্মিক পবিত্র প্রভৃতি বিশেষণ প্রয়োগ করিয়া আপনাদিগকে পরমসম্মানিত জ্ঞান করি। এইরূপে অনেক