পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ Vrv) স্বাভাবিক দূষণীয়তা সম্বন্ধে চার্চের অধ্যক্ষগণ বিপরীত বিদ্বেষের সহিত মত প্রকাশ করিয়াছেন ; খৃস্টীয় সাধু টাটলিয়ন স্ত্রীলোককে শয়তানের প্রবেশদ্বার, নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফলচীের, দিব্যধর্ম-পরিত্যাগিনী, মনুষ্যরূপী-ঈশ্বরপ্রতিমাবিনাশিনী আখ্যা দিয়াছেন । এবং সেন্ট ক্রিসস্টম স্ত্রীলোককে প্রয়োজনীয় পাপ, প্রকৃতির মায়াপািশ, মনোহর বিপৎপাত, গাৰ্হস্থ্য সংকট, সাংঘাতিক আকর্ষণ এবং সুচিকণ অকল্যাণ শব্দে অভিহিত করিয়াছেন । । তখন কোনো উচ্চ অঙ্গের ধর্মানুষ্ঠানে স্ত্রীলোকদের অধিকার ছিল না। জনসমাজে মিশিতে, প্রকাশ্যে বাহির হইতে, কোনাে ভোজে বা উৎসবে গমন করিতে তাহাদের কঠিন নিষেধ ছিল। অন্তরালে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া মীেনাবলম্বনপূর্বক স্বামীর আজ্ঞা পালন করা এবং তাত চরকা ও রন্ধন লইয়া তার পর মধ্যযুগে যখন শিভলরি-ধর্মের অভ্যুদয়ে যুরোপে নারীভক্তির প্রচার হইল, স্ত্রীলোকদের প্ৰতি উৎপীড়ন এবং প্রতারণা তখনকার কালেরও একটি প্রধান লক্ষণ ছিল । বহুবিবাহ এবং গোপন বিবাহ কেবল কুলীন নহে সাধারণের মধ্যেই প্রচলিত ছিল । ধর্মযাজকেরাও তাঁহাদের চিরকৌমাৰ্যব্ৰত লঙঘন করিয়া একাধিক বৈধ অথবা অবৈধ বিবাহ করিত । পুরাবৃত্তবিৎ হ্যালাম দেখাইয়াছেন যে, জার্মান ধর্মসংস্কারকগণ সন্তানাভাবে এককালীন দুই অথবা তিন বিবাহ বৈধ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন । সকলেই জানেন মহারাজ শার্লমানের বহু পত্নী ছিল । খৃস্টধর্মবৎসল জাস্টিনিয়নের অধিকার কালে কনস্টান্টিনোপলের রাজপথ স্ত্রীলোকের প্রতি কী নিদারুণ অত্যাচারের দৃশ্যস্থল ছিল। একটি স্ত্রীলোক সুন্দরী এবং বিদুষী ছিলেন, এইমাত্র অপরাধে কোনো খৃস্টান সাধুর অনুচরগণ র্তাহাকে আলেকজান্দ্ৰিয়ার রাজপথে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া বধ করিয়াছিল। লেখক বলিতেছেন, হিন্দু ধর্মশাস্ত্রকার মনুর অনুশাসন আছে যে, স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হইলে তাহাকে চতুষ্পথে ডালকুত্তার দ্বারা টুকরা টুকরা করিয়া ফেলাই বিধান— যদি সেন্ট সীরিল স্ত্রীলোক সম্বন্ধে কোনো গ্ৰন্থ লিখিতেন তবে কি মনুর সহিত তাহার মতের সম্পূর্ণ ঐক্য হইত না । যুরোপের মধ্যযুগে স্ত্রীলোক সদাসর্বদাই উৎপীড়িত, বলপূর্বক অপহৃত, কারামধ্যে বন্দীকৃত, এবং পরমথুস্টান য়ুরোপের উপরাজগণের দ্বারা কশাহত হইত। খৃস্টানগণ তাহাদিগকে দগ্ধ করিতে, জলমগ্ন করিতেও কুষ্ঠিত হইত না । । এমন সময় মহম্মদের আবির্ভাব হইল । মর্তলোকে স্বৰ্গরাজ্যের আসন্ন আগমন প্রচার করিয়া লোকসমাজে একটা হুলস্থূল বাধাইয়া দেওয়া তাহার উদ্দেশ্য ছিল না । সে-সময়ে আরব সমাজে যে-উচ্ছঙ্খলতা ছিল তাঁহাই যথাসম্ভব সংযত করিতে তিনি মনােনিবেশ করিলেন। পূর্বে বহুবিবাহ, দাসীসংসর্গ ও যথেচ্ছ স্ত্রীপরিত্যাগের কোনো বাধা ছিল না ; তিনি তাহার সীমা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া স্ত্রীলোককে অপেক্ষাকৃত মান্যপদবীতে আরোপণ করিলেন। তিনি বার বার বলিয়াছেন, স্ত্রীবর্জন ঈশ্বরের চক্ষে নিতান্ত অপ্রিয় কার্য। কিন্তু এ প্রথা সমূলে উৎপাটিত করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত ছিল না। এইজন্য তিনি স্ত্রীবর্জন একেবারে নিষেধ না করিয়া অনেকগুলি গুরুতর বাধার সৃষ্টি করিলেন। লেখক বলেন, স্ত্রীলোকের অধিকার সম্বন্ধে খৃস্টীয় আইন অপেক্ষা মসুলমান আইনে অনেক উদারতা প্রকাশ পায় । হিন্দুশাস্ত্রে যেমন বিশেষ বিশেষ কারণে স্বামীত্যাগের বিধি আছে কিন্তু হিন্দুসমাজে তাহার কোনো চিহ্ন নাই, সেইরূপ লেখক বলেন, মুসলমানুশাস্ত্রেও অত্যাচার, ভরণপোষণের অক্ষমতা প্রভৃতি কারণে স্ত্রীর স্বামীত্যাগের অধিকার আছে। আমরা যেরূপ লীলাবতী ও খনার দৃষ্টান্ত সর্বদা উল্লেখ করিয়া থাকি, লেখক সেইরূপ প্রাচীন কালের মুসলমান বিদুষীদের দৃষ্টান্ত সংগ্ৰহ করিয়া তৎকালীন আরবরমণীদের উন্নত অবস্থা প্রমাণ করিয়াছেন । যাহা হউক, মান্যবর আমির আলি মহাশয় প্রমাণ করিয়াছেন যে, কোনো কোনো বিষয়ে মুসলমানদের প্রাচীন সামাজিক আদর্শ উচ্চতর ছিল এবং মহম্মদ যে-সকল সংস্কারকার্যের সূত্রপাত করিয়াছিলেন, তাহাকেই তিনি চূড়ান্ত স্থির করেন নাই। মধ্যস্থ হইয়া তখনকার প্রবল সমাজের সহিত উপস্থিতমত রফা করিয়াছিলেন । কতকগুলি পরিবর্তন সাধন করিয়া সমাজকে পথ নির্দেশ