পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৭৫৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী ণিজন্ত শব্দ সম্বন্ধেও পণ্ডিতমহাশয়ের সেইরূপ অটল জেদ, তিনি বলেন, ণিজন্তV কেন বলিব না। অবশ্য বলিব বলে না কি কেহ কারণ বিহনে ? আমরা ব্যাকরণে পণ্ডিত নই, তবু আমরা যতটা বুঝিয়াছি, তাহাতে শিচু একটা সংকেত মাত্রযেখানে সে-সংকেত খাটে না, সেখানে তাহার কোনোই অর্থ নাই। দ্ণিচু-এর সংকেত বাংলায় খাটে না, তবু পণ্ডিতমশায় যদি ঐ কথাটাকে বাংলায় চালাইতে চান, তবে তাহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সংস্কৃত নীেকান্দাড়ে চলে, অতএব বাংলা ফসলের খেতে লাঙল চলিবে কেন, নিশ্চয় দাড় চলিবে । কিন্তু দাড় জিনিস অত্যন্ত দামি উৎকৃষ্ট জিনিস হইলেও তবু চলিবে না। শ্রু ধাতু যে-নিয়মে “শ্রাবি হয়, সেই নিয়মে শুন ধাতুর ‘শু” “শো হইয়া ও পরে ইকার যোগে ‘শৌনিতেছে’ হইত। হয়তো খুব ভালোই। হইত, কিন্তু হয় না যে সে আমার বা মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের দােষ নহে। সংস্কৃত পঠ ধাতুর উত্তরে ণিচূ প্রত্যয় করিয়া পাঠন হয়, বাংলায় সেই অর্থে পড় ধাতু হইতে পড়ােনা হয় “পাড়ন হয় না । অতএব সেখানে তাহার সংকেতই কেহ মানিবে না, সেখানে অস্থানে অকারণে বৃদ্ধ ণিছ সিগ্নালার তাহার প্রাচীন পতাকা তুলিয়া কেন বসিয়া থাকিবে, সে নাই-ও। তাহার স্থলে আর-একটি যে-সংকেত বসিয়া আছে, সে হয়তো তাহারই শ্ৰীমান পৌত্র, আমাদের ভক্তিভাজন শিচু নহেকৌলিক সাদৃশ্য তো কিছু থাকিবেই, কিন্তু ব্যবহারের ব্যতিক্রমেই তাহার স্বাতন্ত্র্য ধরা পড়ে। তবু যদি বাংলায় সেইণিচূ প্রত্যয়ই আছে বলিতে হয়, তবে ধ্রুপদের প্রতি সম্মান দেখাইবার জন্য কাওয়ালিকে চোতাল নাম দিলেও দোষ হয় না । প্ৰতিবাদে লিখিত হইয়াছে । যে সকল শব্দ লইয়া অভিনব ব্যাকরণ নির্মাণের চেষ্টা হইতেছে, উহা একান্ত অকিঞ্চিৎকর । ঐ সকল শব্দের বহুল প্রয়োগে ভাষার গুরুত্ব ও মাধুর্য কতদূর রক্ষিত হইবে, তাহা নির্ণয় করা সহজ নহে। বাংলা বলিয়া একটা ভাষা আছে, তাহার গুরুত্ব মাধুর্য ওজন করা ব্যাকরণকারের কাজ নহে। সেই ভাষার নিয়ম বাহির করিয়া লিপিবদ্ধ করাই তাহার কাজ । সে-ভাষা যে ইচ্ছা ব্যবহার করুক বা না-করুক, তিনি উদাসীন। কাহারও প্রতি র্তাহার কোনো আদেশ নাই, অনুশাসন নাই। জীবতত্ত্ববিৎ কুকুরের বিষয়ও লেখেন, শেয়ালের বিষয়ও লেখেন। কোনো পণ্ডিত যদি তাহাকে ভৎসনা করিতে আসেন যে, তুমি যে শিয়ালের কথাটা এত আনুপূর্বিক লিখিতে বসিয়াছ, শেষকালে যদি লোকে শেয়াল পুষিতে আরম্ভ করে - তবে জীবতত্ত্ববিদ তাহার কোনো উত্তর না দিয়া তাহার শেয়াল সম্বন্ধীয় পরিচ্ছেদটা শেষ করিতেই প্রবৃত্ত হন। বঙ্গদর্শন-সম্পাদক যদি তাহার কাগজে মাছের তেলের উপর বৈজ্ঞানিক প্ৰবন্ধ লেখেন, তবে আশা করি কোনো পণ্ডিত র্তাহাকে এ অপবাদ দিবেন না যে, তিনি মাছের তেল মাথায় মাখিবার জন্য পাঠকদিগকে অন্যায় উত্তেজিত করিতেছেন । । প্ৰতিবাদ-লেখক মহাশয় হাস্যরসের অবতারণা করিয়া লিখিয়াছেন : যদি কেহ লেখেন, যুধিষ্ঠির দ্ৰৌপদীকে বলিলেন-প্রিয়ে, তুমি যে-কথা বলিতেছ। তাহার বিসমোল্লায়ই গলদ’ তাহা হইলে প্রয়োগটি কি অতিশোভন হইবে । প্রয়োগের শোভনতাবিচার ব্যাকরণের কাজ নহে, অলংকারশাস্ত্রের কাজ- ইহা পণ্ডিতমহাশয় জানেন না, এ কথা বিশ্বাস করিতে আমাদের সাহস হয় না। উল্লিখিত প্রয়োগে ব্যাকরণের কোনো ভুলই নাই, অলংকারের দোষ আছে। “বিসমোল্লায় গলদ” কথাটা এমন জায়গাতেও বসিতে পারে যেখানে অলংকারের দোষ না হইয়া গুণ হইবে । অতএব পণ্ডিতমশায়ের রসিকতা এখানে বাজে খরচ হইল। যাহারা প্ৰাকৃত বাংলার ব্যাকরণ লিখিতেছেন, তাহারা এই হাস্যবাণে বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবেন না। শ্ৰীযুক্ত পণ্ডিতমহাশয় এ কথাও মনে রাখিবেন যে, চলিত ভাষা অস্থানে বসাইলেই যে কেবল ভাষার প্রয়োগদোষ হয়, তাহা নহে; বিশুদ্ধ সংস্কৃতশব্দ বিশুদ্ধ সংস্কৃতনিয়মে বাংলায় বসাইলেও অলংকারদোষ ঘটিতে পারে। কেহ যদি বলেন, আপনার সুন্দরী বক্তৃতা শুনিয়া অদ্যকার সভা আপ্যায়িতা হইয়াছে, তবে তাহাতে স্বগীয় বোপদেবের কোনো আপত্তি থাকিবার কথা নাই, কিন্তু