পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । শব্দতত্ত্ব Գ @ ֆ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা ভাই, তুমি যে লড়াই করিতে বলিতেছ, আমার অপরাধটা কী । পাঠান বলিল, তুমি যে আমার সামনে গোফ তুলিয়া আছ, সেই অপরাধ। রাজপুত তৎক্ষণাৎ গোফ নামাইয়া দিয়া কহিল, আচ্ছা ভাই, গোফ নামাইয়া দিতেছি । প্রতিবাদী মহাশয়ের কাছে আমারও প্রশ্ন এই যে, ঐ “ছাগল” “বাঁচালী “থ্যাৎলা’ এবং নৈমিত্তিক শব্দ কয়েকটি লইয়াই কি আমার সঙ্গে তাহার বিবাদ । আচ্ছা আমি গোফ নামাইয়া লইতেছি- ও শব্দ কয়টা একেবারেই ত্যাগ করিলাম। তাহাতে মূল প্রবন্ধের কোনােই ক্ষতিবৃদ্ধি হইবে না। ইহাতে বিবাদ মিটিবে কি। প্রতিবাদী বলিবেন, অকিঞ্চিৎকর কথাগুলো বাংলায় ঢোকাইয়া তুমি ভাষাটাকে মাটি করিবার চেষ্টায় আছ। আমার বিনীত উত্তর এই যে, ঐ কথাগুলো আমার এবং তাহার বহুপূর্ব পিতামহ-পিতামহীরা প্রচলিত করিয়া গেছেন, আমি তাহাদের রাখিবারই বা কে, মারিবারই বা কে । প্রতিবাদী মহাশয়ের হুকুম হইতে পারে, আচ্ছ বেশ, ভাষায় আছে থােক, তুমি ওগুলার নিয়ম আলোচনা করিয়ো না । কিন্তু এ হুকুম চলিবে না। গোফের এই ডগাটুকু নামাইতে পারিব না । যে-কথাগুলি লইয়া আজ এত তর্ক উঠিল তাহা এতই সোজা যে, পাঠক ও শ্রোতাদের এবং “সাহিত্য-পরিষৎ-সভা’র সম্মানের প্রতি লক্ষ করিয়া চুপ করিয়া থাকাই উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, শেক্সপীয়ার যাহা বলিয়াছেন, তাহা সকলের পক্ষেই খাটে । তিনি বলেন, দুৰ্ভাগ্য একা আসে না, দলবল সঙ্গে করিয়াই আসে । প্ৰতিবাদী মহাশয়ও একা নহেন, তাহার দলবল আছে । তিনি শাসাইয়াছেন যে, “বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বি. এ. এম. এ. উপাধিধারী এবং “বর্তমান সময়ে যে-সকল লেখক ও লেখিকা গ্ৰন্থ প্রণয়ন করিতেছেন তাহারা এবং ‘ইংলন্ডপ্রত্যাগত অনেক কৃতবিদ্য' তাহার দলে আছেন — ইহাতে অকস্মাৎ বাংলাভাষার এত হিতৈষী অভিভাবকের ভিড় দেখিয়া এতকালের উপেক্ষিতা মাতৃভাষার জন্য আশাও জন্মে। অথচ নিজের অসহায়তায় হৃৎকম্পও উপস্থিত হয় । সেই কারণে পণ্ডিতমহাশয়ের দল ভাঙাইয়া লইবার জন্যই আমার আজিকার এই চেষ্টা । তাহাদিগকে আমি । আশ্বাস দিতেছি, এ দলে আসিয়াও র্তাহারা ভাষার বিশুদ্ধি ও মাধুর্য রক্ষায় মনােযোগ করিলে আমরা কেহ বাধা দিব না, চাই কি, আমরাও শিক্ষা লাভ করিতে পারিব। কেবল র্তাহাদিগকে এই অত্যন্ত সহজ কথাটুকু স্বীকার করিতে হইবে যে, বাংলাভাষা বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে চলে এবং সে-ব্যাকরণ সম্পূর্ণরূপে সংস্কৃত ব্যাকরণের দ্বারা শাসিত নহে। ইহাতে র্তাহাদের কৃতবিদ্যতা ও ইংলন্ডপ্রত্যাগমনের গৌরব ক্ষুন্ন হইবে না, অথচ আমিও যথেষ্ট সম্মানিত ও সহায়বান হইব । S \) Obr বিবিধ পত্রিকায় চণ্ডিদাসের যে নূতন পদাবলী প্রকাশিত হইতেছে তাহা বহুমূল্যবান - সম্পাদক মহাশয় । আদর্শ পুঁথির বানান সংশোধন করিয়া দেন নাই। সেজন্য তিনি আমাদের ধন্যবাদভাজন। প্রাচীন গ্ৰন্থসকলের যে-সমস্ত মুদ্রিত সংস্করণ আজকাল বাহির হয় তাহাতে বানান-সংশোধকগণ । কালাপাহাড়ের বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছেন। তাহারা সংস্কৃতবানানকে বাংলাবানানের আদর্শ কল্পনা করিয়া যথাৰ্থ বাংলাবানান নির্বিচারে নষ্ট করিয়াছেন । ইহাতে ভাষাতত্ত্বজিজ্ঞাসুদিগের বিশেষ অসুবিধা ঘটিয়াছে। বর্তমান সাহিত্যের বাংলা বহুলপরিমাণে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের উদভাবিত বলিয়া বাংলাবানান, এমন-কি, বাংলাপদবিন্যাসপ্রণালী তাহার স্বাভাবিক পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে, এখন তাহাকে স্বপথে ফিরাইয়া লইয়া যাওয়া সম্ভবপর নহে। কিন্তু আধুনিক বাংলার আদর্শে র্যাহারা প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করিতে থাকেন তাহারা পরম অনিষ্ট করেন।