পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

votr SR রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী প্রাচীন লিখিত ভাষার সব’ শব্দ বিশেষ্যপদের পরে যুক্ত হইত। এখন সে রীতি উঠিয়া গেছে, এখন কেবল পূর্বেই তাহার ব্যবহার আছে। কেবল বর্তমান কাব্যসাহিত্যে এখনাে ইহার প্রয়ােগ দেখা যায়— যথা, পাখি সব করে রব”। বর্তমানে বিশেষ্যপদের পরে ‘সব' শব্দ বসাইতে হইলে বিশেষ্য বহুবচন রূপ গ্রহণ করে। যথা, পাখিরা সব, ছেলেরা সব অথবা ছেলেরা সবাই। বলা বাহুল্য, জীববাচক শব্দ ব্যতীত অন্যত্র বহুবচনে এই রা’ ও ‘এরা” চিহ্ন বসে না। বানরগুলা সব, ঘোড়াগুলা সব, টেবিলগুলা সব, দােয়াতগুলা সব- এইরূপ গুলাযোগে, সচেতন অচেতন সকল অনেক” বিশেষণ শব্দ যখন বিশেষ্যপদের পূর্বে বসে তখন স্বভাবতই তদদ্বারা বিশেষ্যের বহুত্ব বুঝায়। কিন্তু এই ‘অনেক” বিশেষণের সংস্রবে বিশেষ্যপদ পুনশ্চ বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না। ইংরেজিতে many বিশেষণ সত্ত্বেও man শব্দ বহুবচন রূপ গ্রহণ করিয়া men হয়- সংস্কৃতে অনেক লোকাঃ, কিন্তু বাংলায় অনেক লোকগুলি হয় না। অথচ সকল বিশেষণের যোগে বিশেষ্যপদ বিকল্পে বহুবচন রূপও গ্রহণ করে। আমরা বলিয়া থাকি, সকল সভ্যেরাই এসেছেন— সকল সভাই এসেছেন এরূপও বলা যায়। কিন্তু অনেক সভ্যেরা এসেছেন কোনোমতেই বলা চলে না। সব’ শব্দও সকল” শব্দের ন্যায়। সব পালোয়ানরাই সমান” এবং সব’ পালোয়ানই সমান” দুই চলে। “বিস্তর' শব্দ ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়। অর্থাৎ এই বিশেষণ পূর্বে থাকিলে বিশেষ্যপদ আর বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না-“বিস্তর লোকেরা” বলা চলে না। ' এইরূপ আর-একটি শব্দ আছে তাহা লিখিত বাংলায় প্রায়ই ব্যবহৃত হয় না— কিন্তু কথিত বাংলায় তাহারই ব্যবহার অধিক, সেটি ‘ঢের’। ইহার নিয়ম বিস্তর’ ও ‘অনেক’ শব্দের ন্যায়ই। ‘গুচ্ছার’ শব্দও প্রাকৃত বাংলায় প্রচলিত। ইহা প্রায়ই বিরক্তি-প্রকাশক। যখন বলি গুচ্ছার লোক জমেছে তখন বুঝিতে হইবে সেই লোকসমাগম গ্ৰীতিকর নহে। ইহা সম্ভবত গোটাচার শব্দ হইতে टेन्ट्रट । সংখ্যাবাচক বিশেষ্য পূর্বে যুক্ত হইলে বিশেষ্যপদ বহুবচন রূপ গ্রহণ করে না। যেমন, চার দিন, তিন জন, দুটাে আম! গণ, দল, সমূহ, বৃন্দ, বৰ্গ, কুল, চয়, মালা, শ্রেণী, পঙক্তি প্রভৃতি শব্দযোগে বিশেষ্যপদ বহুত্ব অর্থ গ্রহণ করে। কিন্তু ইহা সংস্কৃত রীতি। এইজন্য অবিকৃত সংস্কৃত শব্দ ছাড়া অন্যত্র ইহার ব্যবহার নাই। বস্তুত ইহাদিগকে বহুবচনের চিহ্ন বলাই চলে না। কারণ ইহাদের সম্বন্ধেও বহুবচনের প্রয়োগ হইতে পারে- যেমন সৈন্যগণেরা, পদাতিক দলেরা ইত্যাদি। ইহারা সমষ্টিবোধক ৷ ইহাদের মধ্যে ‘গণ’ শব্দ প্রাকৃত বাংলার অন্তৰ্গত হইয়াছে। এইজন্য ‘পদাতিকগণ’ এবং "পাইকগণ’ দুই বলা চলে। কিন্তু লাঠিয়ালবৃন্দ’, ‘কলুকুল’ বা ‘আটচালাচয়' বলা চলে না। গণ, মালা, শ্রেণী ও পঙক্তি শব্দ সর্বত্র ব্যবহৃত হইতে পারে না। গণ ও দল কেবল প্ৰাণীবাচক শব্দের সহিতই চলে। কখনো কখনো রূপকভাবে মেঘদল তরঙ্গদল বৃক্ষদল প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। মালা, শ্রেণী ও পঙক্তি শব্দের অর্থ অনুসারেই তাহার ব্যবহার, এ কথা বলা বাহুল্য। প্রাকৃত বাংলায় এইরূপ অৰ্থবোধক শব্দ বাক, গোচ্ছা, আঁটি, গ্রাস। কিন্তু এগুলি সমাস-রূপে শব্দের সহিত সংযুক্ত হয় না। আমরা বলি পাখির কঁক, চাবির গোচ্ছা, ধানের আঁটি, ভাতের গ্রাস, অথবা দুই বঁটাক পাখি, এক গোচ্ছা চাবি, চার আঁটি ধান, দুই গ্রাস ভাত।