পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা ○ ○> প্রচলিত আছে, তাহা কালক্রমে জনসাধারণে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িবে, তখন আবেগের ভাষাও বিস্তুত হইয়া পড়িবে। এখন যেমন সভ্যদেশে ভাবপ্রকাশক ভাষা অত্যন্ত অসম্পূর্ণ অবস্থা হইতে এমন দ্রুত উন্নতি লাভ করিতেছে যে, অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল ভাবসকলও তাঁহাতে অতি পরিষ্কাররূপে প্রকাশ হইতে পারিতেছে, তেমনি আবেগের ভাষা যদিও এখনো অসম্পূর্ণ রহিয়াছে, তথাপি ক্ৰমে এতদূর উন্নতি লাভ করিতে পরিবে যে, আমরা আমাদের হৃদয়া বেগ অতি জাজ্বলারুরূপে ও সম্পূর্ণরূপে অন্যের হৃদয়ে মুদ্রিত করিতে পারিব। সকলেই জানেন, অভদ্রদের অপেক্ষা ভদ্রলোকদের গলা অধিক মিষ্ট। একজন অভদ্র যাহা বলে, একজন ভদ্র ঠিক তাহাঁই বলিলে অপরের অপেক্ষা অনেক মিষ্ট শুনায়। তাহার কারণ আর কিছুই নহে, আভদ্রের অপেক্ষা একজন ভদ্রের অনুভবের চর্চা অধিক হইয়াছে, সুতরাং অনুভব প্রকাশের উপায়ও তীহাদের সহজ ও স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছে; তাহার ঠিক সুরগুলি তাহারা জানেন, কণ্ঠস্বরেই বুঝা যায় যে তঁহারা ভদ্র। বহুকাল হইতে র্তাহারা ভদ্রতার ঠিক সুরটি শুনিয়া আসিতেছেন, তাহাঁই ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন। অনুভবপূৰ্ণ সংগীত যাহারা চর্চা করিয়া থাকেন তাহদের যে অনুভবের ভাষা বিশেষ মার্জিত ও সম্পূৰ্ণ হইবে তাঁহাতে আশ্চৰ্য্য কী আছে? সুন্দর রাগিণী শুনিলে আমাদের হৃদয়ে যে সুখের উদ্রেক হয়, তাহার কারণ বোধ করি, অতি দূর ভবিষ্যতে উন্নত সভ্যতার অবস্থায় যে এক সুখময় অনুভবের দিন আসিবে, সুন্দর রাগিণী তাহারই ছায়া আমাদের হৃদয়ে আনয়ন করে। এই-সকল রাগিণী, যাহার উপযুক্ত অনুভব আজকাল আমরা খুজিয়া পাই না, এমন সময় আসিবে যখন সচরাচর ব্যবহৃত হইতে পরিবে। আজ সুরসমষ্টি মাত্র আমাদের হৃদয়ে যে সুখ দিতেছে, উন্নত যুগে অনুভবের সহিত মিলিয়া লোকদের তাহার দ্বিগুণ সুখ দিবে। ভালো সংগীত শুনিলে আমাদের হৃদয়ে যে একটি দূর অপরিস্ফুট আদর্শ-জগৎ মায়াময়ী মরীচিকার ন্যায় প্রতিবিম্বিত হইতে থাকে, ইহাই তাহার কারণ। এই তো গেল স্পেনসারের মত । আমাদের দেশে সংগীত এমনি শাস্তুগত, ব্যাকরণগত, অনুষ্ঠানগত হইয়া পড়িয়াছে, স্বাভাবিকতা হইতে এত দূরে চলিয়া গিয়াছে যে, অনুভবের সহিত সংগীতের বিচ্ছেদ হইয়াছে, কেবল কতকগুলা সুরসমষ্টির কর্দমা এবং রাগরাগিণীর ছাদ ও কাঠামো অবশিষ্ট রহিয়াছে ; সংগীত একটি খুণ্ডিকাময়ী প্রতিমা হইয়া পড়িয়ছে ; তাহাতে হৃদয় নাই, প্ৰাণ নাই। এইরূপ একই ছাঁচে ঢালা, অপরিবর্তনশীল সংগীতের জড় প্রতিমা আমাদের দেবদেবী মূর্তির ন্যায় বহুকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। সংগীতে এতখানি প্ৰাণ থাকা চাই, যাহাতে সে সমাজের বয়সের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের পরিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তুত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্ৰযুক্ত হয়। সমাজবৃক্ষের শাখায় শুদ্ধমাত্র অলংকার স্বরূপে সংগীত নামে একটা সোনার ডাল বাধিয়া দেওয়া হইয়াছে, গাছের সহিত সে বাড়ে না, গাছের রসে সে পুষ্ট হয় না, বসন্তে তাহাতে মুকুল ধরে না, পাখিতে তাহার উপর বসিয়া গান গাহে না। গাছের আর-কিছু উপকার করে না কেবল শোভা বর্ধন করে। তাহাও করে কি না শোভাবর্ধনের কথা যদি উঠিল। তবে তৎসম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলা আবশ্যক। সংগীতকে যদি শুদ্ধ কেবল শিল্প, কেবল মনোহারিণী বিদ্যা বলিয়া ধরা যায়, তাহা হইলেও স্বীকার করিতে হয় যে আমাদের দেশীয় অনুভব-শূন্য সংগীত নিকৃষ্ট শ্রেণীর। চিত্রশিল্প দুই প্রকারের আছে। এক-অনুভবপূর্ণ মুখশ্ৰী ও প্রকৃতির অনুকৃতি, দ্বিতীয়- যথাযথ রেখাবিন্যাস দ্বারা একটা নেত্র