পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br রবীন্দ্র-রচনাবলী সেখানে তার আকার আয়তন ও বস্তুপরিমাণ সম্পূর্ণ সীমাবদ্ধভাবে তার আপনারই। কিন্তু যেখানে পদ্মটি অনির্বচনীয় সেখানে সে যেন আপনার সমস্তটার চেয়েও আপনি অনেক বেশি। এই বেশিটুকুই তার সংগীত। পদ্মের যেখানে এই বেশি সেখানে তার সঙ্গে আমার বেশিরও একটা গভীর মিল। তাই তো গাইতে পারি- ; আজি কমলমুকুলদল খুলিল! ) গগন মগন হল গন্ধে ; সমীরণ মূৰ্ছে আনন্দে ; গুন গুন গুঞ্জনছন্দে নিখিল ভুবনমন ভুলিল, মন ভুলিল। . . . হৃদয়ের আনন্দে আর পদ্মে অভেদ হইল- ভাষার একেবারে উলটাপালট হইয়া গেল। যার রূপ নাই সে রূপ ধরিল, যার রূপ আছে সে অরূপ হইল। এমন-সব অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটিতেছে কোথায়? সৃষ্টি যেখানে অনির্বাচনীয়তায় আপনাকে আপনি ছাড়াইয়া যাইতেছে। আমাদের রাগরাগিণীতে সেই অনির্বাচনীয় বিশ্বরসটিকে নানা বড়ো বড়ো আধারে ধরিয়া রাখার চেষ্টা হইয়াছে। যখন কাল হয় নাই তখন কলিকাতায় গঙ্গার জল যেমন করিয়া জালায় ধরা হইত। যজ্ঞকর্তা আপন ইচ্ছা ও শক্তি অনুসারে নানা গড়নের ও নানা ধাতুর পাত্রে সেই রাস পরিবেশন করিতে পারেন, কিন্তু একই সাধারণ জলাশয় হইতে সেটা বহিয়া আনা । অর্থাৎ আমাদের মতে রাগরাগিণী বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে নিত্য আছে। সেইজনা আমাদের কালোয়াতি গানটা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাহা যেন সমস্ত জগতের । ভৈরোঁ যেন ভোরবেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ ; পরািজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহবলতা ; কানাড়া যেন, ঘনান্ধকারে অভিসারিকা নিশীথিনীর পথবিস্মৃতি ; ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদন', মুলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনাস্তের ক্লান্তিনিশ্বাস; পূরবী যেন শূন্যগৃহ চারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রমোচন । ভারতবর্ষের সংগীত মানুষের মনে বিশেষভাবে এই বিশ্বরসটিকেই রসাইয়া তুলিবার ভার লইয়াছে। মানুষের বিশেষ বেদনাগুলিকে বিশেষ করিয়া প্রকাশ করা তার অভিপ্রায় নয়। তাই, বে: সাহানার সুর আচঞ্চল ও গভীর, যাহাতে আমোদ-আহ্বাদের উল্লাস নাই, তাঁহাই আমাদের বিবাহউৎসবের রাগিণী । নরনারীর মিলনের মধ্যে যে চিরকালীন বিশ্বতত্ত্ব আছে সেইটিকে সে স্মরণ করাইতে থাকে, জীবজন্মের আদিতে যে দ্বৈতের সাধনা তাহারই বিরাট বেদনাটিকে ব্যক্তিবিশেখের্ব বিবাহঘটনার উপরে সে পরিব্যাপ্ত করিয়া দেয়। । আমাদের রামায়ণ মহাভারত সুরে গাওয়া হয়, তাহতে বৈচিত্ৰ্য নাই, তাহ রাগিণী নয়, তাহার সুর মাত্র। আর কিছু নয়, ওটুকুতে কেবল সংসারের সমস্ত তুচ্ছতা দীনতা এবং বিচ্ছিন্নতার উপরের দিকে একটু ইশারা করিয়া দেয় মাত্র। মহাকাব্যের ভাষাটা যেখানে একটা কাহিনী বলিয়া চলে, সুর সেখানে সঙ্গে সঙ্গে কেবল বলিতে থাকে- আহো, অহো, অহো! স্কিতি আপে মিশন