পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা Ö ፴ (ሱ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতশিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতশিক্ষার ব্যবস্থা সম্বন্ধে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে তা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ চলছে। ইচ্ছা ছিল না। এর মধ্যে প্রবেশ করি। প্রথম কারণ, আমার শরীর অপটু ; দ্বিতীয় কারণ, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের শিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত ভার সম্প্রতি আমি নিজের হাতে নিয়েছি। শরীর যখন দুর্বল তখন একান্ত আমার আশু কৰ্তব্যের বাইরে অন্য কর্তব্যের মধ্যে নিজেকে জড়িত করা শক্তির অমিতব্যয়িতা, তাতে ব্যর্থতার সৃষ্টি করে। কিন্তু অকাজকে অগ্রসর হয়ে গ্রহণ না করলেও বাইরে থেকে সে ঘাড়ে এসে পড়ে, তখন তাকে অস্বীকার করতে গেলে জটিলতা আরো বেড়ে R | r শিক্ষাবিভাগ থেকে কিছুদিন হল এক পত্র পেয়েছিলুম, তাতে সংগীত-শিক্ষার প্রবর্তন সম্বন্ধে আমার পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। বিষয়ের গুরুত্ব বিচার করে আমি চুপ করে থাকতে পারি নি। উত্তরে লিখেছিলুম-বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতশিক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোেলবার পক্ষে অধ্যাপক ভািট্রখণ্ডেই যোগ্যতম। আশা করেছিলুম এইখানেই আমার কাজ ফুরোলো। কর্মফলের পরম্পরা এখনো শেষ হয় নি। চিঠিপত্ৰযোগে তর্কবিতর্কের জালের মধ্যে জড়িত হয়ে পড়েছি। বর্তমানে বাংলা দেশে শ্ৰীযুক্ত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রেষ্ঠ গায়ক বলেছি, এই কারণে কিছু ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে ; সেটা পরিষ্কার করা ভালো। সাধারণত আমরা যাদের ওস্তাদ বলি, পুরাতন বিদ্যাধারাকে রক্ষা করা সম্বন্ধে তাদের বিশেষ একটা উপযোগিতা আছে। তারা সংগ্রহ করেন, সঞ্চয় করেন, সংগীত ব্যাকরণের বিশুদ্ধতা বঁচিয়ে রাখেন। চিরপ্রচলি ৩ রাগারগিণীকে চিরপ্রচলিত প্রথার কাঠামোর মধ্যে শ্রেণীবদ্ধ ভাবে ধরে রাখবার কাজে অক্লান্ত অধ্যবসায়ে তঁদেরকে প্রবৃত্ত হতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই একমাত্র এই কাজেই তাদের দেহ মন প্ৰাণ নিযুক্ত { সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর তাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক নয় ; অনেকের ৩া নেই, অনেকে তাকে অবজ্ঞাই করেন। গান সম্বন্ধে তীদের প্রতিভার স্বকীয়তাও বাহুল্য, এমনকি, তাতে হয়তো তঁদেয় আপন কর্মের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তঁরা একান্ত অবিকৃত ভাবে প্রাচীন ধারাকে অনুসরণ করে চলেন এইটেই তাদের গর্বের বিষয়। এই রকম রক্ষকতার মূল্য আছে। সমাজ সেই মূল্য তঁদের যদি না দেয়। তবে তাঁদের প্রতিও অন্যায় করে, নিজেরও ক্ষতি ঘটায়। হিন্দুস্থানী সংগীত এমন একটি কলাবিদ্যা যার রচনার নিয়ম বহুকাল পূর্বেই সমাপ্ত হয়ে গেছে! সেই বহুকাল পূর্বের আদর্শের সঙ্গে মিলিয়েই তার বিচার চলে। যাঁরা সেই আদৰ্শমতেই বহু পরিশ্রমে এই জাতীয় সংগীতের সাধনা করেছেন, হিন্দুস্থানী সংগীত সম্বন্ধে তঁদের সাক্ষাকেই প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করতে হয় । । སྟ এই ওস্তাদ-সম্প্রদায়ের মধ্যেও গুণের তারতমা নিশ্চয়ই আছে। কারো গানের সংগ্ৰহ অন্যের .চয়ে হয়তো বহুলতার ; রাগরাগিণীর রূপের পরিচয় হয়তো এক ওস্তাদের চেয়ে অন্য ওস্তাদের অধিকতর বিশুদ্ধ ; তাল তানের প্রয়োগ সম্বন্ধে কারও বা কসরত অন্যের চেয়ে বিস্ময়জনক। ওস্তাদির চেয়ে বড়ো একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে দরদ। সেটা বাইরের জিনিস নয়, ভিতরের জিনিস। বাইরের জিনিসের পরিমাপ আছে, আদর্শে ধরে সেটা সম্বন্ধে দাঁড়িপাল্লার বিচার চলে। তার চেয়ে বড়ো যেটা সেটাকে কোনাে বাইরের আদর্শে মাপা চলে না ; সেটা হল সহৃদয়হৃদয়বেদ্যা! কে সহৃদয় আর কে সহৃদয় নয় বাইরে থেকে তারও তল পাওয়া যায় না, তার শেষ নিম্পেত্তি করবার ব্যর্থ চেষ্টা মাথা-ফাটাফাটিতে গিয়ে পৌঁছয়- অর্থাৎ যাকে বলে হিংস্ৰ দুঃসহযোগ! - .