পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা @ Գ Տ) কবিবর বললেন, “মোটেই না। হিন্দুস্থানী সংগীতের যে-একটি উদার বিশেষত্ব, যেটাকে তুমি বলেছ সুরের মধ্য দিয়ে শিল্পীর নিত্যনিয়ত নব নব সৌন্দর্যসৃষ্টির স্বাধীনতা-সেটা য়ুরোপের সংগীতের সঙ্গে তুলনা করে আরো স্পষ্ট বুঝতে পারি।” আমি বললাম, “এটা খুবই ঠিক। আমারও যুরোপে অনেকবার মনে হয়েছিল যে, আমাদের শুধু সংগীত নয়, সভ্যতায়ও, ভারতীয় বৈশিষ্ট্যটি ঠিক-ঠিক বুঝতে হলে একবার পাশ্চাত্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচয় লাভ করা খুব দরকার। নইলে আমাদের বিশিষ্ট দানটি সম্বন্ধে আমাদের ঠিক যেন চোখ ফোটে না।” ՞, কবিবর বললেন, ‘সত্যি কথা। কিন্তু একটা বিষয় আমি তোমাকে আজ একটু বিশেষ করে বলতে চাই। তুমি এটা কেন মানবে না যে, হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারার বিকাশ যে ভাবে হয়েছে, আমাদের বাংলা সংগীতের ধারা সে ভাবে বিকাশ লাভ করে নি? এ দুটাের মধ্যে প্রকৃতিভেদ আছে। বাংলার সংগীতের বিশেষত্বটি যে কী তার দৃষ্টান্ত আমাদের কীর্তনে পাওয়া যায়। কীর্তনে আমরা যে আনন্দ পাই সে তো অবিমিশ্র সংগীতের আনন্দ নয়। তার সঙ্গে কাব্যরসের আনন্দ একাত্মা হয়ে মিলিত ।” আমি বললাম, কিন্তু সুর-” কবিবর বললেন, কীর্তনে সুরও অবশ্য কম নয় ; তার মধ্যে কারুনিয়মের জটিলতাও যথেষ্ট আছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও কীর্তনের মুখ্য আবেদনটি হচ্ছে তার কাব্যগত ভাবের, সুর তারই সহায় মাত্র। এ কথাটা আরো স্পষ্ট বােঝা যায় যদি কীর্তনের প্রাণ অর্থাৎ আঁখির কী বস্তু সেটা একটু ভেবে দেখা যায়। সেটা শুধু কথার তান নয় কি ? হিন্দুস্থানী সংগীতে আমরা সুরের তান শুনে মুগ্ধ হই, সংগীতের সুরবৈচিত্র্য তনালাপে কেমন মূর্ত হয়ে উঠতে পারে সেইটেই উপভোগ করি।-নয় কি ? কিন্তু, কীর্তনে আমরা পদাবলীর মর্মগত ভােবরসটিকেই নানা আঁখরের মধ্য দিয়ে বিশেষ করে নিবিড়ভাবে গ্রহণ করি। এই আঁখির, অর্থাৎ বাক্যের তরুন, অগ্নিচক্র থেকে স্মৃলিঙ্গের মতো কাব্যের নির্দিষ্ট পরিধি অতিক্রম করে বর্ষিত হতে থাকে। সেই বেগবান অগ্নিচক্রটি হচ্ছে সংগীত-সম্মিলিত কাব্য। সংগীতই তাকে সেই আবেগবেগের তীব্রতা দিয়েছে যাতে করে নূতন নূতন আঁখির তা থেকে ছিটিয়ে পড়তে পারে। গীতহীন কাব্য যেখানে স্তব্ধ থাকে। সেখানে আঁখির চলে না। বিদ্যাপতি-পািঠ-কালে পাঠক তাতে নুতন বাক্য যোজনা করলে ফৌজদারি চলে। কারণ, পাঠক তো বিদ্যাপতি নয়। কিন্তু ছন্দোবদ্ধ বিশুদ্ধ কাব্য হিসাবে আখরে যে দৈন্য অনিবাৰ্য, কীর্তনের সুরের ঐশ্বর্য সেটাকে পূরণ করে দেয় বলেই সেটাতে রসের সহায়তা করে। অতএব দেখা যাচ্ছে কীর্তনে-সুরে বাক্যে অর্ধনারীশ্বর যোগ হয়েছে। যোগের এই দুই অঙ্কের মধ্যে কে বড়ো কে ছােটাে সে বিচারের চেষ্টা করা উচিত নয়। উভয়ের যোগে যে সৌন্দর্য সম্পূর্ণতা লাভ করেছে, উভয়কে বিচ্ছিন্ন করে দিলে সেই সৌন্দর্যকেই হারাতে হবে। জলের থেকে অক্সিজেনকেই নিই বা হাইড্রোজেনকেই নিই, তাতে জলটাই যায় মারা। বাংলা পদগনি জলেরই মতো যৌগিক সৃষ্টি, তা দুইয়ে মিলে অখণ্ড। হিন্দুস্থানী গান রূঢ়িক, তা একাই বিশুদ্ধ। সৃষ্টি ব্যাপারে রূঢ়িক শ্রেষ্ঠ নী যৌগিক শ্রেষ্ঠ এ তর্কের কোনাে অর্থ নেই। ভালো যা তা ভালো ব'লেই ভালো-রূঢ়িক বলৈও না, যৌগিক বলেও না।... . . ,, . . . আমি বললাম, 'বাংলার-যে কাব্যে একটা নিজস্ব দান আছে। এ কথা কে না মানবো? কিন্তু, তাই বলে কি প্রমাণ হয় যে আমাদের সংগীতের বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে না। আমাদের দেশে বড়ো বড়ো কবি জন্মেছেন সত্য ; কিন্তু তা থেকে তো সিদ্ধান্ত করা চলে না যে, আমাদের দেশে