পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সংগীতচিন্তা kd? কৃতজ্ঞ বোধ হয় যখন দেখি যে আমি যা উপলব্ধি করছি অপরের মনেও তার রঙ ধরছে—তাই না তারা সায় দিল প্ৰশংসার ঢেউ তুলে। কিন্তু, পরে- যখন আমাদের আত্মপ্রতীতি দানা বাঁধে, গোধূলির ছায়া যখন আলোর কাছে হার মানে, তখন কী দরকার অপরের স্বীকৃতির ? তখন কি মনে হয় না- আমি যা পেয়েছি তা যখন নিশ্চয়ই পেয়েছি তখন অপরের না করায় তো আর সেটা না পাওয়া হয়ে যেতে পারে না? আনন্দ হল সৃষ্টি অনুষঙ্গী, নিত্যসঙ্গী- সে যখন এসে বলে “অয়মহং ভোঃ- আমি আছি হে’ তখন তাকে নামঞ্জর করবে। সাধ্য কার? কাজেই তখনো কেন আমরা হাত পাতিব অপরের কাছে- তা সে আমাদের সমসাময়িকদের কাছেই হোক বা নিত্যকালের ভাবী সভাসদদের কাছেই হোক ? স্বয়ং আত্মপ্রতীতি যখন শিরোপা দিল তখন অপরের সেলামি তৃপ্তি দিতে পারে, কিন্তু অপরিহার্য সে নয়। ...আমি যখন গান বাঁধি তখনি সব চেয়ে আনন্দ পাই! মন বলে— প্রবন্ধ লিখি, বক্তৃতা দিই, কর্তব্য করি, এ-সবই এর কাছে তুচ্ছ। আমি একবার লিখেছিলাম যবে কাজ করি, প্ৰভু দেয় মোরে মান। যাবে গান করি, ভালোবাসে ভগবান ; এ কথা বলি কোন ?--- এইজন্যে যে, গানে যে আলো মনের মধ্যে বিছিয়ে যায়। তার মধ্যে আছে এই দিব্যবোধ যে, যা পাবার নয় তাকেই পেলাম আপন করে নতুন করে। এই বোধ যে, জীবনের হাজারো অবাস্তর সংঘর্ষ হানাহানি তর্কাতর্কি এ-সব এর তুলনায় বাহা- এই ই হল সারবস্তু— কেননা, এ হল আনন্দলোকের বস্তু, যে লোক জৈবলীলার আদিম উৎস। প্রকাশলীলায় গান কি না। সব চেয়ে সূক্ষ্ম— ethereal— তাই তো সে অপরের স্বীকৃতির স্থূলতার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয়, নিজের হৃদয়ের বাণীকে সে রাঙিয়ে তোলে সুরে। যেমন, ধরো, যখন ভালোবাসার গান গাই তখন পাই শুধু গানের আনন্দকেই না ; ভালোবাসার উপলব্ধিকেও মেলে এমন এক নতুন নৈশ্চিত্যের মধ্যে দিয়ে যে, মন বলে পেয়েছি তাকে যে অধরা, যে আলোকবাসী, যে “কাছের থেকে দেয় না। ধরা— দূরের থেকে ডাকে'। “কিন্তু, তা বলে এ কথা মনে করে বোসো না যেন যে, নিত্যকালের সাড়াকে আমি অস্বীকার করছি। বরং নিতােকালকে মানি ব'লেই বর্তমান কালকে অতিস্বীকারের মর্যাদা দিতে বাধে। না বেধেই পারে না। কারণ, প্রতি যুগের মধ্যেই আছে বটে কয়েকটি নিতাকালের মন, যাদের নাম রাসিক মন- কিন্তু, বাকি সব ? তাদের মন তো নিতামন নয়, সত্য রসিক তো তারা নয়। অতীত কালের সাড়া দেবার নানান ধারা পর্যালোচনা ক'রে ও ভাবী কালের সাড়া কল্পনা করে তবে এ কথা বুঝতে পারি, চিনতে পারি তাদেরকে যাদের জনো গান বঁধি, কবিতা লিখি!. 'যুরোপে প্রথম যৌবনে যখন আমি ওদের গান শুনতে যাই ৩খন আমার ভালো লাগে নি। কিন্তু, আমি দেখতাম সার বেঁধে পরপর ওরা দাঁড়িয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টিকিটের জন্যে। কী যে আগ্রহ, কী যে আনন্দ ওদের ভালো কনসার্ট-হলে ভালো গান শুনে- দেখেছ তো তুমিও স্বচক্ষে। প্রথম-প্রথম আমি বুঝতাম না। ওদের গান। কিন্তু তা বলে এ কথা কখনো বলি নি যে,