পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vexe0R রবীন্দ্র-রচনাবলী আমারও থাকবে আমারই। তাতে কিছু আসে যায় না, কেননা সংগীতটা সৃষ্টির ক্ষেত্র। যারা সৃষ্টি করবে। তারা নিজের পন্থা নিজেই বেছে নেবে- পুরানো নতুনের সমন্বয় তাদের কাজের দ্বারাই, বাধা মতের দ্বারা নয়। তুমি বলছি ভারতের ধ্রুপদী সংগীত সম্বন্ধে তোমার প্রধান মন্তব্য আলাপ নিয়ে। ও সম্বন্ধে কিছু বলা কঠিন। আলাপের উপাদান-রূপে আছে বিশেষ রাগরাগিণী, সেগুলি গানের সীমার দ্বারা পূর্ব হতেই কোনো রচয়িতার হাতে নির্দিষ্ট রূপ পায় নি। আলাপে গায়ক আপন শক্তি ও রুচি অনুসারে তাদের রূপ দিতে দিতে চলেন। এ স্থলে অত্যন্ত সহজ কথাটা এই : যিনি পারলেন রূপ দিতে তাকে আর্টিস্ট হিসাবে বলব ধন্য ; যিনি পারলেন না, কেবল উপাদানটাকে নিয়ে তুলো ধুনতে লাগলেন, তাকে গীতবিদ্যবিশারদ বলতে পারি, কিন্তু আর্টিস্ট বলতে পারি নে- অর্থাৎ তাকে ওস্তাদ বলতে পারি, কিন্তু কালোয়াত বলতে পারব না। কালোয়াত, অর্থাৎ কলাবৎ। কলা শব্দের মধ্যেই আছে সীমাবদ্ধতার তত্ত্ব- সেই সীমা, যেটা রূপেরই সীমা। সেই সীমা রূপের আপন আন্তরিক তাগিদেই অপরিহার্য। প্রদর্শনীতে সীমা অপরিহার্য নয়, সেটা কেবলমাত্র বাহিরের স্থানাভাব বা সময়াভােব বশতই ঘটে। আলাপ যদি রাগিণীর প্রদর্শনীর দায়িত্ব নেয় তা হলে সেই দিক থেকে বিচার করে তাকে প্রশংসা করাও চলে। যে দুর্বলাত্মা পাণ্ডিত্যের ভারে অভিভূত হয় সে প্রশংসা করেও থাকে ; সে লুব্ধমুগ্ধভাবে মনে করে অনেক পাওয়া গেল। কিন্তু ‘অনেক’-নামক ওজনওয়ালা পদার্থই কলাবিভাগের উপদ্রব, যথার্থকলাবৎ তাকে তার মোটা অঙ্কের মূল্য সত্ত্বেও তুচ্ছ করেন। অতএব, আলাপের কথা যদি বলে। তবে আমি বলব আলাপের পদ্ধতি নিয়ে কেউবা রূপ সৃষ্টি করতেও পারেন, কিন্তু রূপের পঞ্চােত্বসাধন করাই অধিকাংশ বলবানের অভ্যাসগত। কারণ, জগতে কলাবৎ “কোটিকে গুটিক মেলে’, বলবতের প্রাদুর্ভাব অপরিমিত। বহুসংখ্যক ফুল নিয়ে তোড়া বঁধাও যায় আর তা নিয়ে দশ-পনেরোটা বুড়ি বোঝাই করাও চলে। তোড়া বঁধতে গেলে তার সাজাই বাছাই আছে, বাদ দিতে হয় তার বিস্তর। তোড়ার খাতিরে ফুল বাদ দিতে গেলে যারা হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ভগবানের কাছে তাদের পরিত্রাণ প্রার্থনা করি। অতএব, আলাপের দরাজ পথ বেয়ে কোন গায়ক সংগীতের প্রতি কী রকম ব্যবহার করলেন সেই ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত নিয়েই বিচার চলে। আলাপ সম্বন্ধে আর্টের আদর্শে বিচার করা কঠিন। তার কারণ, দৌড়তে দৌড়তে বিচার করতে হয় ; ক্ষণে ক্ষণে তাতে যে রস পাওয়া যায়। সেইটে নিয়ে তারিফ করা চলে, কিন্তু সমগ্রকে সুনির্দিষ্ট করে দেখব কী উপায়ে! তানসেনের গান হােক বা গোপাল নায়কেরই হােক, তারা তো নিরন্তর-বিস্মফারিত মেঘের আড়ম্বর নয় ; রূপবান, তাদেরকে চার দিক থেকে দেখা যায়, বার বার বাজিয়ে নেওয়া যায়, নানা গায়কের কণ্ঠে তাদের অনিবাৰ্য বৈচিত্ৰ্য ঘটলেও তাদের যে মূল ঐক্য, যেটা কলার রূপ এবং কলার প্রাণ, মোটের উপরে সেটা থাকে মাথা তুলে। আলাপে সে সুবিধা পাই নে বলে তার সম্বন্ধে বিচার অত্যন্ত বেশি ব্যক্তিগত হতে বাধ্য। যদি কোনো নালিশ ওঠে। তবে সাক্ষীকে পাবার জো নেই। আয়তনের বৃহত্ত্ব যে দোষের নয়। এ সম্বন্ধে তুমি কিছু কিছু দৃষ্টান্ত দিয়েছ। না দিলেও চলত, কারণ আর্টে আয়তনটা গৌণ। রূপ বড়ো আয়তনেরও হতে পারে, ছোটো আয়তনেরও হতে পারে, এবং অরূপ বা বিরূপ ছোটোর মধ্যেও থাকে বড়োর মধ্যেও। বেটোভেনের ‘সোনাটা’ যথেষ্ট বাহরাওয়ালা জিনিস ; কিন্তু বহরের কথাটাই যার সর্বোপরি মনে পড়ে, জীবে দয়ার খাতিরেই সভা থেকে তাকে যত্নসহকারে দূরে সরিয়ে রাখাই শ্রেয়। মহাভারতের উল্লেখ করতে পারতে- আমাদের দেশে ওকে ইতিহাস বলে, মহাকাব্য বলে না। ও একটি সাহিত্যিক galaxy {