পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

. Stry রবীন্দ্র-রচনাবলী বিকশিত যৌবনের সময় যখন তুমি আমাকে সর্বাপেক্ষা ভালোবাসিতে, তখন জীবনের প্রতি । আমার অত্যন্ত মায়া ছিল, কিন্তু যখন আমি ইহা পরিত্যাগ করিলাম, তখন নির্বাসন হইতে - স্বদেশে ফিরিয়া আসিবার আমোদ অনুভব করিতে লাগিলাম। তখন তোমার প্রতি দয়া ভিন্ন অন্য কষ্ট পাই নাই।' আমি বলিয়া উঠিলাম, “সেই সত্যপ্রিয়তা যাহা তুমি পূর্বে জানিতে এবং সর্বাতন্তর্যামীর নিকট থাকিয়া এখন যাহা অধিকতর জান, সেই সত্যপ্রিয়তার নামে জিজ্ঞাসা করিতেছি, বলো, আমার প্রতি সেই দয়া কি প্রেমের দ্বারাই উত্তেজিত হয় নাই?’ আমার এই কথা শেষ না হইতে হইতেই দেখিলাম, সেই স্বগীয় হাস্য, যাহা চিরকাল আমার দুঃখের উপর শান্তি বর্ষণ করিয়া আসিয়াছে, সেই হাস্যে র্তাহার মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল— তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন ও কহিলেন, চিরকাল তুমি আমার প্রেম পাইয়া আসিয়াছ ও চিরকালই তাহা পাইবে। কিন্তু তোমার প্রেম সংযত করিয়া রাখা আমার উচিত মনে করিতাম!” মাতা যখন তাহার পুত্রকে ভৎসনা করেন, তখন যেমন তাহার ভালোবাসা প্ৰকাশ পায় এমন আর কখনো নয়। কতবার আমি মনে মনে করিয়াছি- “উনি উন্মত্ত অনলে দগ্ধ হইতেছেন, অতএব উহাকে আমার হৃদয়ের কথা কখনো বলিব না। হায়, যখন আমরা ভালোবাসি। অথচ শঙ্কায় ত্ৰস্ত থাকি, তখন এ-সব চেষ্টা কী নিৰ্ম্মফল কিন্তু আমাদের সম্রাম বজায় রাখিবার ও ধর্মপথ হইতে ভ্ৰষ্ট না হইবার এই একমাত্র উপায় ছিল। কতবার আমি রাগের ভান করিয়াছি, কিন্তু তখন হয়তো আমার হৃদয়ে প্ৰেম যুঝিতেছিল। যখন দেখিতাম তুমি বিষাদের ভরে নত হইয়া পড়িতেছ, তখন হয়তো তোমার প্রতি সাস্তুনার দৃষ্টি বর্ষণ করিতাম, হয়তো কথা কহিতাম। দুঃখ এবং ভয়েই নিশ্চয় আমার স্বর পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছিল, তুমি হয়তো তাহা দেখিয়াছ! যখন তুমি রোষে অভিভূত হইয়াছ তখন হয়তো আমি আমার একটি দৃঢ়-দৃষ্টির দ্বারা তোমাকে শাসন করিতাম! এই সকল কৌশল, এই সকল উপায়ই আমি অবলম্বন করিয়াছিলাম। এইরূপে কখনো অনুগ্রহ, কখনো দৃঢ়তার দ্বারা তোমাকে কখনো সুখী কখনো বা অসুখী করিয়াছি, যদিও তাঁহাতে শ্ৰান্ত হইয়াছিলে, কিন্তু এইরূপে তোমাকে সমুদয় বিপদের বাহিরে লইয়া গিয়াছিলাম, এইরূপে আমাদের উভয়কেই পতন হইতে পরিত্রাণ করিয়াছিলাম— এবং এই কথা মনে করিয়া আমি অধিকতর সুখ উপভোগ করি!” যিখন তিনি কহিতে লাগিলেন, আমার নেত্ৰ হইতে অশ্রু পড়িতে লাগিলআমি কঁাপিতে কঁাপিতে উত্তর দিলাম- যদি আমি তাহার কথা স্পর্ধপূর্বক বিশ্বাস করিতে পারি, তবে আমি আপনাকে যথার্থ পুরস্কৃত জ্ঞান করি।- আমাকে বাধা দিয়া তিনি কহিলেন, বলিতে বলিতে র্তাহার মুখ আরক্তিম হইয়া আসিল হা- অবিশ্বাসী, সংশয় করিতেছ। কেন? যদিও আমার হৃদয়ে যেমন ভালোবাসা ছিল আমার নয়নে তেমন প্রকাশ পাইত কি না, সে কথা আমার রসনা কখনোই ব্যক্ত করিবে না, কিন্তু এই পর্যন্ত বলিতে পারি।- তোমার ভালোবাসায়, বিশেষত তুমি আমার নামকে যে অমরত্ব দিয়াছ তাহাতে যেমন সন্তুষ্ট হইয়াছিলাম। এমন আর কিছুতে না। আমার এই একমাত্র ইচ্ছা ছিল তোমার অতিরিক্ততা কিছু শমিত হয়। আমার কাছে তোমার হৃদয়ের গোপন-কাহিনী খুলিতে গিয়া তাহা সমস্ত পৃথিবীর নিকট খুলিয়াছ এই কারণেই তোমার উপরে আমার বাহ্য-ঔদাসীন্য জন্মে। তুমি যতই দয়ার নিমিত্ত উচ্চৈঃস্বরে ভিক্ষা করিয়াছ, আমি ততই লজ্জা ও ভয়ে নীরব হইয়া গিয়াছি। তোমার সহিত আমার এই প্ৰভেদ ছিল- তুমি । প্ৰকাশ করিয়াছিলে, আমি গোপন করিয়াছিলাম-কিন্তু প্ৰকাশে যন্ত্রণা যে বধিত হয় ও গোপনে তাহা হ্রাস হয় এমন নহে।’ তাহার অনুরক্ত তখন তঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, তাহার সহিত যুক্ত হইবার আর কত বিলম্ব আছে? লরা এই বলিয়া চলিয়া গেলেন, যতদূর আমি জানি তাহাতে তুমি আমার বিয়োগ সহিয়া অনেক দিন পৃথিবীতে থাকিবে।’ পিত্রার্ক লরার মৃত্যুর পর ছাব্বিশ বৎসর বাঁচিয়াছিলেন। এইরূপে পিত্রার্ক লরার দৃঢ়তা, তাহার প্রতি উদাসীনতার মধ্য হইতেও তাঁহার আপনার ইচ্ছার অনুকুল অৰ্থ ব্যাখ্যা করিয়া লইয়াছিলেন। তিনি সহজেই মনে করিতে পারেন যে, লরার