পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য - Q ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ না হইয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, যাহারা স্বদেশকে অন্তরের সহিত ভালোবাসে তাহারা স্বদেশের সহিত সর্বতোভাবে অন্তরঙ্গরাপে পরিচিত হইতে চাহে এবং ছড়া, রূপকথা, ব্ৰতকথা প্রভৃতি ব্যতিরেকে সেই পরিচয় কখনো সম্পূর্ণতা লাভ করে না। সাধনায় যখন আমি এগুলি সংগ্রহ ও প্রকাশ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিলাম, তখন আমার কোনোপ্রকার মহৎ উদ্দেশ্য ছিল না। সমাজের সুধাভাণ্ডার যে অন্তঃপুর, তাহারই প্রতি স্বাভাবিক হৃদয়-পালিত মধুর কণ্ঠালালিত চিরন্তন কথাগুলিকে স্থায়ী ভাবে একত্র করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম এবং অঘোরবাবুকে এই সমস্ত মেয়েলি ব্ৰত গ্ৰন্থ-আকারে রক্ষা করিতে উৎসাহী করিয়াছি, সেজন্য গভীর-প্রকৃতি পাঠকদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। এবং সেইসঙ্গে এ কথাও বলিয়া রাখি যে, এই সকল সংগ্রহের দ্বারা ভবিষ্যতে যে কোনোপ্রকার গভীর উদ্দেশ্য সাধিত হইবে না, এমনও মনে করি না। এই প্রসঙ্গে শ্ৰীযুক্ত বাবুদীনেন্দ্ৰকুমার রায় মহাশয়ের নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। তিনি বঙ্গ দেশের জনসাধারণ-প্রচলিত পার্বণগুলির উজ্জ্বল ও সুন্দর চিত্ৰ সাধনায় প্রকাশ করিয়া সাধনাসম্পাদকের প্রিয় উদ্দেশ্য সাধনে সহায়তা করিয়াছেন। সে চিত্রগুলি বঙ্গসাহিত্যে স্থায়ীভাবে রক্ষা করিবার যোগ্য এবং আশা করি দীনেন্দ্ৰকুমারবাবু সেগুলি গ্ৰন্থ-আকারে প্রকাশ করিতে কুষ্ঠিত হইবেন না। কার্সিয়াং ৭। কার্তিক ১৩০৩ সাহিত্যের সৌন্দর্য আদিত্য। সাহিত্য জিনিসটা বিষয়ের উপর বেশি নির্ভর করে না রচনার উপরে? লক্ষ্যের উপরে না লক্ষণের উপরে ? নগেন্দ্ৰ। তুমি তো এ কথাও জিজ্ঞাসা করিতে পার মানুষ বাম পায়ের উপর বেশি নির্ভর করে না ডান পায়ের উপর? আদিত্য। মানুষ দুই পায়েরই উপর সমান নির্ভর করে এ যেমন স্পষ্ট অনুভবগোচর, সাহিত্য তার বিষয় এবং রচনাপ্ৰণালীর উপর সমান নির্ভর করে সেটা তেমন নিশ্চয় বোধগম্য নয় এবং এই কারণেই সাহিত্যে আজকাল কেহ বা নীতিকে প্রাধান্য দেন, কেহ-বা সৌন্দর্যকে, কেহ-বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-প্রচারকে। সেইজন্যই আলোচনা উত্থাপন করা গেল। : মন্মথ। বেশ কথা। তা হইলে একটা দৃষ্টান্ত অবলম্বন করিয়া আলোচনা শুরু করা যাক। ভ্রমণকারীদের সুবিধার জন্য যে “গাইড’-বই রচনা করা হয় এবং ভ্রমণবৃত্তান্ত, এ দুইয়ের মধ্যে - কোনটা সাহিত্যলক্ষণােক্রান্ত সে বিষয়ে বোধ করি কারও মতভেদ নাই। আদিত্য। ভালো, মতভেদ নাই- গাইড-বই সাহিত্য নহে। কিন্তু ওই কথাতেই আমার প্রশ্নের - উত্তর পাওয়া যায়। গাইড-বই এবং ভ্রমণবৃত্তম্ভের বিষয় এক, কেবল রচনাপ্রণালীর প্রভেদ। " নগেন্দ্র। আমার মতে দুয়ের বিষয়েরই প্রভেদ। ফিজিক্স এবং কেমিষ্ট যেমন একই বস্তুকে । ভিন্ন দিক দিয়া দেখে এবং সেইজন্য উভয়ের বিষয়কে স্বতন্ত্র বলা যায়, তেমনি গাইড-বই এবং : ভ্রমণবৃত্তান্ত দেশ-বিশেষকে ভিন্ন তরফ হইতে আলোচনা করে। । মন্মথ। গাইড-বইয়ে কেবলমাত্র তথ্যসংগ্ৰহ থাকে, ভ্রমণবৃত্তান্তে ভ্ৰমণকারী লেখকের : ব্যক্তিগত প্রভাব বিদ্যমান এবং তাঁহাতেই সাহিত্যের বিকাশ। ব্যক্তিত্ববর্জিত সমাচারমাত্র বিজ্ঞানে ।