পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম/দৰ্শন f ՏՏԳ হইতে সগুণ ঈশ্বরপ্রেমের মধ্যে একটি পরস্পরসংলগ্ন পরিণতির পর্যায় আছে। কিন্তু ‘হয়’-কে বড়ো করিয়া না” করা যায় এ কথা বিশ্বাস করিতে যেরূপ অসাধারণ মানসিক প্রকৃতির আবশ্যক আমাদের তাহা নাই স্বীকার করিতে হয়। দ্বিতীয় কথা। সৃষ্টিকৌশলের মধ্যে বিশ্বনাথের বিপুল বিচিত্ৰ লীলা” দেখিয়া চুক্সিপ্রার্থী কী করিয়া যে ব্রহ্মের নিগুণস্বরূপ হৃদয়ংগম করিতে সমর্থ হন তাহা আমরা বুঝিতে পরিলাম না। ‘লীলা’ কি নিগুণতা প্ৰকাশ করে? ‘লীলা” কি ইচ্ছাময়ের ইচ্ছাশক্তির বিচিত্র বিকাশ নহে? ‘সৃষ্টিকীেশল’ জিনিসটা কি নিগুৰ্ণ ব্রহ্মের সহিত কোনো যুক্তিসূত্রে যুক্ত হইতে পারে? সৌন্দর্যের একমাত্র কার্য চিত্তহরণ করা অর্থাৎ হৃদয়ের মধ্যে প্রেমের আকর্ষণ সঞ্চার করিয়া দেওয়া। যাহারা প্রেমস্বরূপ সগুণ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন সৃষ্টির সৌন্দর্যের্তাহাদিগকে ঈশ্বরের প্রেম স্মরণ করাইয়া দেয়। ঈশ্বর যে আমাদিগকে ভালোবাসেন এই সৌন্দর্য বিকাশ করিয়াই যেন তাহার পরিচয় দিয়াছেন। তিনি যে কেবল আমাদিগকে অমোঘ নিয়মপাশে বাধিয়া আমাদিগকে বলপূর্বক কাজ করাইয়া লইতে চান তাহা নহে, আমাদের মনোহরণের প্রতিও তাহার প্রয়াস আছে। এই বিশ্বের সৌন্দর্যে তিনি আমাদিগকে বংশীস্বরে আহবান করিতেছেন- তিনি জানাইতেছেন তিনিও আমাদের গ্ৰীতি চান। বৈষ্ণবদের কৃষ্ণরাধার রূপক এই বিশ্বসৌন্দর্য ও প্রেমের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। কৃষ্ণ কি নিগুণ ব্ৰহ্মা ? চন্দ্রনাথবাবু কী বলিবেন জানি না, কিন্তু চৈতন্যদেব অন্যরাপ বলেন। তিনি অহং ব্রহ্মাবাদী দিগকে “পাষণ্ড” বলিয়াছেন। সে যাহাঁই হৌক, সৌন্দর্য বিরাট লয়প্রার্থদিগকে যে কী করিয়া নিগুণ ব্ৰহ্মো মজাইতে পারে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। সেটা আমাদের বুদ্ধির দোষ হইতে পারে এবং সেজন্য চন্দ্ৰনাথবাবু আমাদিগকে যথেচ্ছ গালি দিবেন, আমরা নির্বোধি ছাত্র-বালকের মতো নতশিরো সহ্য করিব, কিন্তু অবশেষে বুঝাইয়া দিবেন। চন্দ্ৰনাথবাবু তাহার প্রবন্ধের একস্থানে প্ৰহ্লাদ ও নারদের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। কিন্তু তঁহার স্মরণ করা উচিত ছিল প্ৰহ্লাদ ও নারদ উভয়েই বৈষ্ণব। উভয়েই ভক্ত এবং প্রেমিক। প্ৰহাদের কাহিনীতে ঈশ্বরের সগুণতার যেরূপ দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে পুরাণের অন্য কোনো কাহিনীতে সেরূপ দেওয়া হয় নাই। প্রকৃত ভক্তির বশে ভক্তের কাছে ঈশ্বর যে কীরূপ প্রত্যক্ষভাবে ধরা দেন ইহাতে তাহাই বর্ণিত হইয়াছে। যে ঈশ্বর নানা বিপদ হইতে ভক্তকে কোলে করিয়া রক্ষা করিয়াছেন এবং অবশেষে নৃসিংহ মূর্তি ধরিয়া দৈত্যকে সংহার করিয়াছেন তিনি কি নিগুণ ব্ৰহ্মা ? প্রসঙ্গক্রমে চন্দ্ৰনাথবাবু বঙ্কিমবাবুকে এক স্থলে সাক্ষ্য মানিয়াছেন। কিন্তু বঙ্কিমবাবু শ্ৰীকৃষ্ণকে গুণের আদর্শরূপে খাড়া করিয়া তাঁহারই অনুকরণের জন্য আমাদিগকে উৎসাহিত করিয়াছেননিগুণতাকে আদর্শ করিয়া অপরূপ পদ্ধতি অনুসারে আত্মসম্প্রসারণ করিতে বলেন নাই। । আসল কথা, যাহারা যথার্থ লয়তত্ত্ববাদী, তাহারা লয়কে লয়ই বলেন, ইংরাজি শিখিয়া তাহাকে আত্মসম্প্রসারণ বলেন না। তঁহাদের কাছে সৌন্দৰ্য কদৰ্য কিছুই নাই, এইজন্য তঁাহারা অতি কুৎসিত বস্তু ও চন্দনকে সমান জ্ঞান করেন। জগৎ তাঁহাদের কাছে যথার্থই অসৎ মায়া, বিশ্বনাথের সৃষ্টিকৌশল ও লীলা নহে। ". . মরুভূমি যেমন বিরাট এ তত্ত্বও তেমনি বিরাট, কিন্তু তাই বলিয়া ধরণীর বিচিত্ৰ শস্যক্ষেত্ৰকে মরুভূমি করা যায় না; অকাতরে আত্মহত্যা করার মধ্যে একটা বিরাটত্ব আছে কিন্তু তাই বলিয়া প্ৰাণীদিগকে সেই বিরাটত্বে নিয়োগ করা কোনো জাতিবিশেষের একমাত্র কর্তব্য-কর্ম বলা যায় না। প্ৰেম প্রবল মোহ, জগৎ প্ৰকাণ্ড প্রতারণা এবং ঈশ্বর নাস্তিকতার নামান্তর এ কথা বিশ্বাস না করিলেও সংসারে বিরাটভাব” চর্চার যথেষ্ট সামগ্ৰী অবশিষ্ট থাকিবো। : আসল কথা, চন্দ্রনাথবাবু নিজের সহৃদয়তাগুণে লয়তত্ত্ব সম্যক গ্ৰহণ করিতে না পারিয়া ফাপরে পড়িয়াছেন। অথচ সেই সহােদয়তাই দেশানুরাগের আকার ধারণ করিয়া তাহার নিকটে লয়তত্ত্বের সর্বোৎকৃষ্ট মাহাত্ম্য প্রমাণের চেষ্টা করিতেছে। সেই হৃদয়ের প্রাবল্যবশতই তিনি