পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম/দৰ্শন \OSG F ৩। অধ্যাত্মতত্ত্ব সকলই মায়া, কেবল আমার আত্মা মায়া হইতে পারে না। শংকরাচার্য দেখাইয়াছেন আপনাকে অস্বীকার করিতে গেলেও স্বীকার না করিয়া থাকিবার জো নাই। এক্ষণে প্রশ্ন এই, জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার সম্বন্ধ কী। তাহার পরবতী রামানুজ, মাধব এবং বল্পভের মত শংকর । পূর্বে হইতেই খণ্ডন করিয়া গিয়াছেন। জীব ব্রহ্মের অংশ হইতে পারে না। কারণ ব্ৰহ্ম অংশরহিত (অংশ বলিতে হয় কালের পর্যায়, নয় দেশের সংস্থান বুঝায়)। জীবাত্মা ব্ৰহ্ম হইতে স্বতন্ত্র হইতে পারে না, কারণ আমরা অনুভবের দ্বারা উপলব্ধি করিয়া থাকি ব্ৰহ্মা একমেবাদ্বিতীয়ম। জীব ব্ৰহ্মের বিকার হইতে পারে না। কারণ, ব্ৰহ্মা নির্বিকার (কান্টের দ্বারাও প্রমাণিত হইয়াছে যে, ব্ৰহ্মা কার্যকরণসম্বন্ধের অতীত)। সিদ্ধান্ত এই যে, জীব ব্রহ্মের অংশও নহে, ব্ৰহ্মা হইতে স্বতন্ত্রও নহে, ব্রহ্মের বিকারও নহে— পরস্তু সম্পূর্ণতা স্বয়ং পরমাত্মা। এই সিদ্ধান্তে বেদাস্তবাদী শংকর, প্লেটাে-দর্শনবাদী প্লোটিনোস এবং কান্ট-দর্শনবাদী শোপেনহীেয়ার ঐক্য লাভ করিয়াছেন। শংকর অপর দুই দার্শনিক হইতে অধিক দূর অগ্রসর হইয়াছেন। তিনি কহেন আমার আত্মাই যদি স্বয়ং ব্ৰহ্ম হইল। তবে সুতরাং সর্বব্যাপকতা, নিত্যতা এবং সর্বশক্তিমত্তাও আমার আছে। (অর্থাৎ, আমি দেশকাল এবং কার্যকরণবন্ধনের অতীত) শংকর কাহেন, যেমন, কাষ্ঠের মধ্যে অগ্নি গোপন থাকে তেমনি এ-সকল শক্তিও আমার মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে, মুক্তির পরে তাহার প্রকাশ হয়। কেনই বা প্রচ্ছন্ন থাকে? শংকর কাহেন উপাধি-সকল তাহার কারণ। . উপাধি কী কী? না, মন এবং ইন্দ্ৰিয়, প্ৰাণ এবং তাহার পঞ্চ শাখা, এবং সূক্ষ্ম শরীর। ইহারাই জন্মে জন্মে আত্মাকে আবৃত করিয়া থাকে। উপাধিত্রয় কোথা হইতে আসিল ? মায়া হইতে। আবার মায়ার উৎপত্তি অবিদ্যা হইতে। কিন্তু এই যে আমাদের অজ্ঞান, পাপ এবং দুঃখের মূল কারণ অবিদ্যা, ইহার কারণ কী? ভারতবর্ষ এবং গ্ৰীস ইহার সদুত্তর দেন নাই। কান্ট কহিতেছেন, তুমি অবিদ্যার কারণ জিজ্ঞাসা করিতেঁছ? অবিদ্যার কারণ থাকিতেই পারে না। যেহেতু এই সংসারের মধ্যেই কার্যকারণসূত্রের অবসান— সংসারের বাহিরে কার্যকারণের শাসন নাই— অতএব আবিদ্যার কারণ অনুসন্ধান বৃথা। এইটুকু জানিলেই যথেষ্ট যে, এই দুঃখ পাপ অজ্ঞান হইতে আমাদের মুক্তিপথ আছে|” ৪। পরকালতত্ত্ব এক্ষণে, সংসার হইতে যে মুক্তির পথ আছে তৎসম্বন্ধে সংক্ষেপে বলা যাউক । বেদের প্রাচীন শ্লোকে প্রথমে স্বৰ্গ এবং পরে নরকের কথা আছে কিন্তু সংসারবাদ অর্থাৎ পুনর্জন্মবাদ কোথাও দেখা যায় না। ’ বেদান্তে স্বৰ্গনারক ভোগ এবং পুনর্জন্ম উভয় মতই মিশ্রিত হইয়াছে। বেদান্তের মতে পুণ্যকারীগণ পিতৃযান প্রাপ্ত হইয়া ক্রমশ চন্দ্ৰলোকে গমন করেন সেখানে আপনি সৎকর্মের ফল নিঃশেষ করিয়া পুনশ্চ মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন। যাহারা সগুণ ব্রহ্মের উপাসক তাহারা । দেবযান মার্গ প্রাপ্ত হইয়া উত্তরোত্তর ব্ৰহ্মলোকে গমন করেন, পৃথিবীতে তেষাং ন পুনরাবৃত্তিঃ, তীহাদের আর পুনরাবৃত্তি নাই। কিন্তু তাহারা যে-ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন। তিনি সগুণ ব্ৰহ্ম এবং এই সগুণ ব্রহ্মের উপাসকেরা যদিচ পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করেন না তথাপি তাহাদিগকে সম্যকদর্শন অর্থাৎ - নিগুণ ব্ৰহ্মের পূর্ণজ্ঞান লাভের দ্বারা মোক্ষাপ্রাপ্তির জন্য প্রতীক্ষা করিতে হয়। এতদব্যতীত পাপকারীদের জন্য নরক যন্ত্রণা এবং তদবসানে বারংবার নীচজন্মভোগ বর্ণিত হইয়াছে। ১. শংকরাচাৰ্য কহিতেছেন- অজ্ঞানং কেন ভবতীতিচেৎ? ন কেন্যাপি ভবতীতি। অজ্ঞানমনাদ্যনির্বাচনীয়ং। অজ্ঞান কাহা হইতে হয়? কাহা হইতেও হয় না। অজ্ঞান অনাদি অনির্বাচনীয়। --অনুবাদক r