পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

दिदिक्ष GGS অনুসারে ? স্পশ্যমান বস্তুর উপরে অটল বিশ্বাস স্থাপন করি কোন যুক্তি অনুসারে? তথাপি আমাদের বিশ্বাস, যুক্তিই সর্বেসর্বা, বিশ্বাস কেহই নয়। ইহা হইতে একটা তুলনা আমার মনে পড়িতেছে। যুক্তি হচ্ছে, স্টিম-এন্জিন, আর বিশ্বাস হচ্ছে রেলের রাস্তা। বিশ্বসুদ্ধ লোকের নজর । এজিনের উপরে; সকলে বলিতেছে- “বাঁহবা, কী কল বাহির হইয়াছে। অত বড়ো গাড়িটাকে অবাধে টানিয়া লইয়া যাইতেছে৷” নীচে যে একটা রেল পাতা রহিয়াছে, ইহা কাহারো চোখে পড়ে না, মনেও থাকে না। বিশ্বাসের রেলের উপর একটা বাধা স্থাপন করে, একটা গাছের গুড়ি ফেলিয়া রাখো, অমনি গাড়ি থামিয়া যায়; দুটি ক্ষুদ্ৰ নুড়ি রাখিয়া দেয়, অমনি গাড়ি উল্টাইয়া পড়ে, ইহা কেহ মনে ভাবিয়া দেখে না কেন? যেখানে বিশ্বাসের রেল, সেইখানেই যুক্তির গাড়ি চলে, যে রাস্তায় রেল পাতা নাই, সে রাস্তায় চলে না,ইহা কাহারো মনে হয় না কেন? তাহার কারণ আর-কিছু নয়; স্টিম-এজিনটা বিষম শব্দ করে, তাহার একটা সারথি আছে, তাহার শরীর প্ৰকাণ্ড, তাহার মধ্যে কত-কী কল উঠিতেছে, পড়িতেছে, এগোইতেছে, পিছাইতেছে; তাহার চোখ দিয়া আলো, নাক দিয়া ধোঁয়া বাহির হইতেছে; পদভরে মেদিনী কম্পমান। আর, রেল কত দিন হইতে পাতা রহিয়াছে, কে পাতিয়াছে, তাহার ঠিকানা নাই; অধিক শব্দ করে না, বরঞ্চ শব্দ নিবারণ করে; নিঃশব্দে রাস্তা দেখাইয়া দেয়, বহন করিয়া লইয়া যায়। সে পথ, সে বিন্নঅপহারক। সে ধ্রুব, নিশ্চল, পুরাতন, ভারবহ। সে কাহারো নজরে পড়ে না; আর, একটা ধূমন্ত, ফুসন্ত, জ্বলন্ত, চলন্ত পদার্থক সকলে সর্বেসর্ব বলিয়া দেখে। রেলের গাড়ির তুলনা যদি উঠিলে, তবে ও বিষয়ে যত কথা উঠিতে পারে, উঠানাে যাক। সাহিত্যের রেল গাড়িতে ভাবগণ বা ভাবুকগণ আরোহী। যশের এঞ্জিনে কালের রাস্তায় চলিতেছে। যে যত মূল্য দিয়াছে, সে তত উচ্চ-শ্রেণীতে স্থান পাইয়াছে, কেহ ফাস্ট ক্লাসে, কেহ সেকেন্ড ক্লাসে, কেহ থার্ড ক্লাসে। যে যত মূল্য দিয়াছে, সে সেই পরিমাণে দূরে যাইতে পরিবে। কােন কালে বাল্মীকি ফাস্ট ক্লাসে টিকিট লইয়া গাড়িতে চড়িয়াছেন, এখনও পর্যন্ত তাঁহার স্টেশন ফুরায় নাই। আমাদের ক্ষীণ দৃষ্টি যতদূর চলে ততদূর চালনা করিয়া কিয়ৎ পরিমাণে অলংকার দিয়া এইরূপ বলিতে পারি যে, যেখানে কালের Terminus- যাহার উধের্ব আর স্টেশন নাই, যে স্টেশনে চন্দ্ৰ সূৰ্যগ্ৰহ নক্ষত্ৰ আসিয়া থামিবে, সেই স্টেশনে যাইবার টিকিট তিনি ক্রয় করিয়াছেন। গাড়ির গার্ড পাঠক সম্প্রদায়, সমালোচক। ইহারা যে নিজের কাজ যথেষ্ট ব্যবহার করিয়া থাকেন। কত শত ভাব তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া গােলমালে প্রথম শ্রেণীতে উঠিয়া পড়ে; সকলেই তাহাকে খাতির করে, সেলাম করে, অভ্যর্থনা করে। এমন দু-এক স্টেশনে কত শত মুখচােরা, ভীরুস্বভাব, সংকোচ-পরায়ণ বেচারি ফাস্ট ক্লাসের টিকিট কিনিয়া, ভিড়ে, গােলেমালো ঠেলাঠািলতে শশব্যস্ত হইয়া থার্ড ক্লাসে উঠিয়া পড়েন, কত শত স্টেশন পার ইয়া সহসা গার্ডের নজরে পড়েন ও তাহারা উপযুক্ত শ্রেণীতে স্থান পান। এই সকল কেইবন্দোবস্ত কােনাে কালে যে দূর হইবে, এমন ভরসা হয় না। সকল বিষয়েই দেখো, জগতে মূল্য দিয়া তােহর উপযুক্ত সামগ্ৰী খুব কম লোকেই পাইয়াছে; হয় দোকানদার তাহাকে ঠকাইয়াছে নয়, সে L দোকানদারকে ঠিকইয়াছে। এসকল কেবল অসাবধানিতার ফল। যত দিন রেলগাড়ি থাকিবে, উক্ত দিন শত শত ফাস্ট ক্লাসের আরোহী থার্ড ক্লাসে চড়িবে, থার্ড ক্লাসের আরোহী ফাস্ট ক্লাসে গড়বে, ইহা নিবারণের উপায় দেখিতেছি না। কিন্তু ইহা অপেক্ষা আর-একটা আমার দুঃখ আছে।