পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტ62 მ) রবীন্দ্র-রচনাবলী কত রহস্য আছে, তাহা উদভেদ করিতে কত যত্ন, কত নিপুণতা, কত সহৃদয়তার আবশ্যক। লেখক ঘরে বসিয়া অবজ্ঞােভরে বঙ্গ-কবিদের জীবনের উপর দিয়া যে, তাহার মহৎ লেখনীর একটা কালির আঁচড় চালাইয়া গিয়াছেন কাজটা তাহার মতো লোকের উচিত হয় নাই। কারণ, তাহার প্রবন্ধে তিনি খুব উচ্চাদরের নীতি-উপদেশ দিয়াছেন, অতএব লেখার সহিত লেখকের জীবনের যদি অবশ্যম্ভাবী যোগ থাকে তবে তাহার নিকট হইতেও ন্যায়াচরণ সম্বন্ধে মহৎ দৃষ্টান্ত প্রত্যাশা করিতে পারি। যাহা হউক, একটা কথা স্মরণ রাখা উচিত- আজিকালিকার কবি যদি কাব্যে কাপট্য করেন সত্য হয়, যাঁহারা সমালোচনা করেন। কবিকে উপদেশ দেন তাহারা যে অকৃত্রিম সারল্য প্রকাশ করিয়া থাকেন তাহারও প্রমাণ আবশ্যক। আসল কথা, কাব্যই লিখুন। আর সমালোচনাই লিখুন, সকল বিষয়েই অধিকার অনধিকার আছে, তাহাই বুঝিতে না পারিয়া অনেক লেখক মিথ্যা কাব্য লেখেন এবং অনেক সমালোচক কাব্য হইতে যথার্থ সত্য ও সৌন্দর্য উদ্ধার করিতে অক্ষমতা প্ৰকাশ করিয়া থাকেন। ‘সুখাবতী’। বিখ্যাত ভ্ৰমণকারী শ্ৰীযুক্ত শরৎচন্দ্ৰ দাস মহাশয় সুখাবতী অর্থাৎ বৌদ্ধ স্বৰ্গ সম্বন্ধে এই প্ৰবন্ধ লিখিয়াছেন। হিন্দু-মুসলমানদের স্বর্গে যেরূপ ভোগের প্রলোভন আছে বৌদ্ধদের স্বর্গে সেরূপ নাই। বৌদ্ধ স্বৰ্গে প্রাণীগণ হিংসাদ্বেষ ভুলিয়া পরস্পরের উপকার ও সুখবর্ধনে নিযুক্ত। ‘তাঁহাদের এই মূলমন্ত্র যে, জগতে যাহা-কিছু সুখ আছে, সমস্তই পরের উপকার করিতে বাসনা করিলেই লাভ করা যায়। স্বার্থচিন্তাতে কেবল অনবচ্ছিন্ন দুঃখরাশিই উৎপন্ন হইয়া থাকে, কল্পবৃক্ষগণেরও ফলপ্ৰদান সময়ে স্বভাবতই শরীর কম্পিত হইয়া থাকে, অপরিসীম ক্ষীর সমুদ্রও অমৃতাভিলাষী দেবগণ -কর্তৃক মথিত হইয়া কম্পিত হন, কিন্তু সুখাবতীবাসী বোধিসত্ত্বগণ পর্যার্থে শত শতবার শরীর দানে নিষ্কম্পভাবে দণ্ডায়মান হইতে সমর্থ। সে সময়ে তাহাদের দেহ আনন্দে পুলকোৎকর বহন করে।” আমরা এই প্ৰবন্ধ পাঠ করিয়া বিশেষ আনন্দ লাভ করিলাম। চৈত্র মাসের সাহিত্যে’ শ্ৰীযুক্ত রজনীকান্ত গুপ্ত মহাশয় ‘প্রাচীন ভারত' প্ৰবন্ধে খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ রাজা শিলাদিত্যের রাজত্বকালীন সন্তোষক্ষেত্রের উৎসব’ ব্যাপারের যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা পাঠ করিয়া আমরা পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছি। শিলাদিত্যের রাজত্বকালে পাঁচবার এই উৎসবকাৰ্য যথাবিধি সম্পাদিত হইয়াছিল।. গঙ্গাযমুনার সংগম-স্থল পরম পবিত্র প্রয়াগ এই মহােৎসবের ক্ষেত্র। এই স্থানের পাঁচ-ছয় মাইল পরিমাণের বিষ্ঠীর্ণ ভূমিতে উৎসবকার্য সম্পন্ন হইত। দীর্ঘকাল হইতে এই ভূমি “সন্তোষক্ষেত্ৰ’ নামে পরিচিত হইয়া আসিতেছিল। এই ক্ষেত্রের চারি হাজার বগফিট পরিমিত ভূমি গোলাপ ফুলের গাছে পরিবেষ্টিত হইত। পরিবেষ্টিত স্থানের বৃহৎ বৃহৎ গৃহে, স্বর্ণ ও রৌপ্য, কার্পাস ও রেশমের নানাবিধ বহুমূল্য পরিচ্ছদ এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য স্তুপাকারে সজ্জিত থাকিত। এই বেষ্টিত স্থানের নিকটে ভোজনগৃহ-সকল বাজারের দোকানের ন্যায় শ্রেণীবদ্ধভাবে শোভা পাইত। এই সমস্ত গৃহের এক-একটিতে একেবারে প্রায় সহস্ৰ লোকের ভোজন হইতে পারিত। উৎসবের অনেক পূর্বে সাধারণ্যে ঘোষণা দ্বারা ব্ৰাহ্মণ, শ্রমণ, নিরাশ্রয়, দুঃখী বা মাতাপিতৃহীন, আত্মীয়বন্ধু-শুন্য, নিঃস্ব ব্যক্তিদিগেকে নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্ৰ প্ৰয়াগে আসিয়া দানগ্রহণের জন্য আহবান করা হইত। মহারাজ শিলাদিত্য আপনার মন্ত্রী ও করদ রাজগণের সহিত এই স্থানে উপস্থিত থাকিতেন। বল্লভী-রাজ ধ্রুবপতু ও আসাম-রাজকুমার এই করদ রাজগণের মধ্যে প্রধান ছিলেন। এই করদ রাজা ও মহারাজ শিলাদিত্যের সৈন্য, সন্তোষক্ষেত্রের সুপ্রিতিবাদ করিয়া থাকিস্ত। বিপত্র সৈন্যর বহুসংখ্য অভাগত লােক আপনাদের তাম্ স্থাপন করত। অসীম আড়ম্বরের সহিত উৎসবের কার্য আরম্ভ হইত। শিলাদিত্য বৌদ্ধধর্মের পরিপোষক।