পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট 4૦૧ চায় না, বিদেশের সর্ববিদ্যাভিমানী গ্রন্থকারের কথাই তাঁহাদের বেদবাক্য, প্রাচীন প্রথার অনুসরণ করিতে নিতান্ত বিমুখ, এবং ভালোই হউক আর মন্দই হউক তাহা লঙ্ঘন করিতে পারিলে আপনাকে মহাবীর বলিয়া মনে করে, সকলেই মনে করে, আমারই উপর বিধাতা এই অসভ্য বঙ্গদেশের সংস্কারের ভার অর্পণ করিয়াছেন, আমার কথাতেই সকলে চলিবে, আমি কাহারো কথায় চলিব না, এবং যাহারা একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করেন বা তথা হইতে নিৰ্গত হন, সকল বিষয়েই আমার অধিকার আছে, এইজন্য তিনি বুঝুন, বা না বুঝুন সকল কথা লইয়াই তোলাপাড়া করিয়া থাকেন। যাহা হউক, আমাদের এই নব্য বংশ এখনও বৃদ্ধদের শাসনে আছেন, কিন্তু যখন এই প্ৰাচীন বংশ লোপ পাইবেক, তখন এই যথেচ্ছাচারী শত শত শিক্ষিত লোক কী গোলযোগ বাধাইবেন কে বলিতে পারে। এই সকল ভাবিয়া অনেকে ভয় পাইতেও পারেন, কিন্তু আমরা বলি এ বিপ্লব চিরকাল থাকিবে না। নিদ্রোমীলিত নয়নে নূতন জ্ঞানের আলোক লাগিয়া বঙ্গবাসীরা অন্ধ হইয়া গিয়াছেন, তাহারা দিগবিদিক-শূন্য হইয়া কী করবেন। ভাবিয়া পাইতেছেন না। যখন এই আলোক তঁহাদের চক্ষে সহিয়া যাইবে, তখন আবার তাহারা চারি দিক স্পষ্টতর দেখিতে পাইবেন এবং দেশ-কাল-পাত্ৰ বুঝিয়া কৰ্তব্যাকর্তব্য নির্ধারিত যথেচ্ছরিতাকেই স্বাধীনতা বলিয়া আলিঙ্গন করেন ও স্বদেশকে ঘূণা করাকেই সার্বভৌমিক ভাব মনে করেন। এ অবস্থা যে চিরকাল থাকিবে আমরা সে ভয় করি না, কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের ভয় হয়। এখন এই যে একটি সম্পূর্ণ নূতন ভাবস্রোত বহিতেছে, ইহাতে যাহা-কিছু সময়ের অনুযোগীতাহা ভাঙিয়া যাইবে বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে যাহা উপযোগী তাহাও ভাঙিয়া যাইতে পারে, বা যাহা অনুপযোগী তাহাও নূতন ভাসিয়া আসিতে পারে, এই বিষয়ে আমাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য; সহস্ৰ-সহস্ৰ বৎসরে যাহা গঠিত হয়, তাহা ভাঙিয়া গেলে গড়িতে কত পরিশ্রম করিতে হইবে এবং সহস্ৰ বৎসরে যাহারা ভার বহনে আমরা সমর্থ হইব, এখনই তাহা স্কন্ধে লইলে চাপা পড়িয়া মরিতে হইবে। বঙ্গদেশের সামাজিক-বিপ্লব যে চিরকাল তিষ্ঠিতে পরিবে না, এখনই তাহার প্রমাণ পাইতেছি। আমাদের দেশের যুবকেরা যখন প্রথম ইংরাজি শিক্ষা পাইয়াছিলেন, তখন যাহা-কিছু দেশীয় তাহারই উপর তাঁহাদের আন্তরিক ঘূণা ছিল ও যাহা-কিছু বিদেশীয় তাহারই উপর তাঁহাদের অতিশয় অনুরাগ জন্মিয়াছিল; এমন-কি, বিদেশীয় পানাহার। চলিত হওয়াও র্তাহারা বঙ্গদেশের সভ্যতার একটি মুখ্য অঙ্গ বলিয়া মনে করিতেন; কিন্তু এখন দেখিতেছি যে, ক্রমে ক্রমে তাঁহাদের সে ভাব অপনীত হইতেছে। এখন দেশীয় কাব্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতির উপর আমাদের অনুরাগ জন্মিতেছে ও বিদেশীয় অনেক আচার-ব্যবহারকে আমরা তুচ্ছ করিতে শিখিয়াছি। আমাদের দেশীয় কোনো লোক বিদেশীয়ের ছদ্মবেশ পরিয়া আসিলে আমরা তাহাকে ঘূণা করি। কিছুদিন আগে কেবল ভাঙা ভাঙা শব্দ পড়িয়া গিয়াছিল, এখন সকলে রাখা রাখা করিয়া ছুটিয়া আসিতেছেন। এখন সমাজে তিন দল উখিত হইয়াছেন। যাহারা আমূল-সংস্কার-প্রিয় তাহারা সকলই ভাঙিতে চান। যাহারা আমূল-রক্ষণ-প্রিয় তাহারা সকলই রাখিতে চান। যাহারা রক্ষণ-সংস্কর-প্রিয় তাহারা যাহা ভালো তাঁহাই রাখিতে চান, যাহা মন্দ তাঁহাই ভাঙিতে চান। এইরূপে উপরি-উক্ত দুইটি শক্তির ঘাত-প্ৰতিঘাতে এবং শেষোক্ত শক্তির উত্তেজনায় সমাজ ঠিক উন্নতির সরল পথে চলিতেছে। উন্নতির পথ মধ্যবতী, উন্নতির পথ এক-বোকা নহে। কেন্দ্রাতিগ এবং কেন্দ্ৰানুগ শক্তি দুই দিক হইতে কোনো বস্তুর উপর কার্য করিলে তাহা মধ্যপথ আশ্রয় করে, আমূল-রক্ষণ-প্রিয় ও আমূল-সংস্কার-প্রিয় এই দুই শক্তি আমাদের সমাজের উপর কার্যকরাতে সমাজ উন্নতির মধ্যবতী। পথে অগ্রসর হইতেছে, তাহাতে আবার রক্ষণ-সংস্কার-প্রিয় উত্তেজনা করাতে সমাজ দ্বিগুণ সাহায্য প্রাপ্ত হইতেছে। যাহারা আমূল-রক্ষণ-প্রিয় তাহারা উন্নতিশীল নাম ধারণ করিতে পারেন ծ Գ || 8Գ