পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

?ffi୪ Գ8ՀՖ একটা অংশ অথবা জীবনধারণের সহিত এবং স্বাভাবিক ও সামাজিক সন্ত্রমরক্ষণের সহিত যে সামগ্ৰীর অলঙ্ঘনীয় সম্বন্ধ, তাহার উপর শুষ্ক বসিয়া সে দ্রব্য দুর্মুল্য বা মহাৰ্থ হইলে মনুষ্য মাত্রেরই মর্মান্তিক বাজে; বিশেষত এই দরিদ্র দেশের দুঃখী লোকদের হৃদয়ে তাহ অধিকতর দারুণভাবে অনুভূত হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুই-একটা দ্রব্যই গ্ৰহণ করুন। প্রথম ধরুন লবণ; লবণের সের ছয় পয়সা মাত্র। তুমি আমি হয়তো মনে করিতে পারি লবণ খুব শস্ত। কিন্তু শতকরা অন্তত ৭০ জন লোকের মধ্যে এ দেশে এখন লবণ শস্ত নয়; মহা মহার্ঘ। লবণ-শুষ্ক অর্থাৎ উক্ত দ্রব্য সরকার বাহাদুরের একচাটিয়া হওয়ার পূর্বে তাহাদের মধ্যে উহা শাস্তা ছিল; তাহাদের অনেকে লবণ প্রস্তুত করিয়া খাইত, গবাদি গৃহপালিত পশুকে খাওয়াইতে পারিত। কিন্তু এখন আর তাহ পারে না। ছয় পয়সা সেরের লবণ কিনিয়া খাইতেও তাহদের কষ্ট হয়। গবাদিকে লবণ খাওয়ানোর তো কথাই নাই; নিজেদের অন্ন জুটিলে অনেক সময়েই তাহাতে লবণ জুটে না। বিনা লবণে ভাত খায় ও আপনি আপনি অদৃষ্টকে অভিসম্পাত করে। ইহা কি খুব একটা সন্তোষের কারণ? স্বদেশীয় সম্পাদক মহাশয়দিগের প্রতিই প্রশ্নটি করিলাম। কেহ কেহ হয়তো লুকাইয়া এক-আধ বিন্দু লবণ তৈয়ারি করিতে যায়; কিন্তু সে পাপের কী প্ৰচণ্ড শাস্তি তাহা । প্রতিদিনের পুলিস রিটার্ন ও ফৌজদারি রিপোর্টেই প্রকাশ। পুনঃ জিজ্ঞাসা করি, ইহাও কি মহাশয় স্বদেশীয় ইতর সাধারণের একটা সস্তোয্যের কারণ? পরন্তু ধরুন কেরেসিন তৈল। কেরোসিন তৈল ক্ৰমে এখন এ দেশের প্রায় আপাদমস্তক প্রচলিত হইয়াছে; কারণ তাহা অন্যান্য তৈল অপেক্ষা শাস্তা। তেলি নিজে সাির্ষপাদির তৈল প্ৰস্তুত করে, তথাচ কেরোসিন তৈল কিনিয়া পোড়ায়; কারণ তাঁহা শস্ত। দরিদ্রের দেশে শস্ত দ্রব্যেরই আদর; শস্ত দ্রব্যেরই আবশ্যক; তা দেশীই হউক আর বিলাতিই হউক; শাস্তাতেই লোকের সুখ শাস্তি সুবিধা। সুতরাং শাস্তাগণ্ডাই গরিব লোকে দেখে; দেশী বিলাতি বুঝে না। ইহা স্বভাবের নিয়ম ও মনুষ্যপ্রকৃতি। তোমার পক্ষপঞ্জরবিহীন ও পুচ্ছহীন পেট্রিয়টিজম দ্বারা মনুষ্যপ্রকৃতি পরিবর্তন করিতে যে চাহ সে কেবল পাগলামি। নেহাত নির্বোিধ ব্যতীত আর কেহই নৈসৰ্গিক নিয়মে হস্তক্ষেপ করিতে যাইয়া হাস্যাম্পদ হয় না। যদি প্রকৃত প্রস্তাবেই পেট্রিয়ট হও, দেশী দ্রব্য ও স্বদেশীয় শিল্পে যথার্থই আন্তরিক অনুরাগ থাকে, তবে তাহার উন্নতিকল্পে আগ্ৰে চেষ্টা করে; প্রাণপণ প্রতিযোগিতা করিয়া দেশী দ্রব্যের দুর্মুল্যত্ব ঘুচাও; নিহিলে তাহা কখনোই গরিব লোকের ব্যবহার্য হইবে না; যে নিজে তাহা স্বহস্তে তৈয়ার করে, সেও তাহা ব্যবহার করিবে না। কিন্তু যাউক সে কথা। গত মার্চ মাসে ট্যারিফট্যাক্সের পুনরাবির্ভাবে কেরোসিন তৈলের মাশুল বৃদ্ধি হইয়া তাহা পূর্বাপেক্ষা মহার্ঘ হইয়াছে। মাণ্ডলের পরিমাণে মূল্য বৃদ্ধি হইয়াছে কি না ঠিক বলিতে পারি না; অত হিসাব করিয়া দেখি নাই। কিন্তু মূল্য বিলক্ষণই বৃদ্ধি হইয়াছে। ওই তৈলের যে টিন ছিল ১ ॥/০ তাহা হইয়াছে এখন ১ প/০: টিন প্রতি অল্পধিক ॥০ বৃদ্ধি। মধ্যবিত্ত গৃহন্থেরই যখন ইহা মর্মান্তিক বাজিয়াছে, তখন গরিব ইতর সাধারণের আর কথা কী! যাহারা এক পয়সার তৈল কিনিয়া তিন রাত্রি পোড়াইত, তাহাদের সে তৈলে এখন পুরা দুই রাত্ৰিও চলে না। অতএব পুনঃ জিজ্ঞাসা করি, কেরোসিন তৈলের এই ‘পোতাটা কি পরম সন্তোষেরই বিষয় হইয়াছে? এখন কেরোসিন তৈলের দৃষ্টান্ত কাপড়ের উপর প্রয়োগ করুন; ফল সেই একই হইবে। দেশী তীতের কাপড় অপেক্ষা বিলাতি বা বোম্বাই কলের কাপড় শাস্তা। সংগতিহীনে শাস্তাই পরে। তঁাতি নিজহস্তে তাত । বুনে; দেশী বস্ত্ৰ তৈয়ার করে; কিন্তু পরে কি? পরে কি শিমলার কালাপেড়ে ? না শান্তিপুরের কঙ্কাপোড়ে ? কিংবা ফরাসডাঙার কাশীপেড়ে ? সম্পাদক শিরোমণিরা নিজে এ-সব বরং পরিয়া বাহার দিতে পারেন। কিন্তু তন্তুবায় তাহা পারে না। তাহার প্রাণে পেটিয়টিজম থাকিলেও হাতে পয়সা নাই। সুতরাং সে স্বহস্তে কষ্কাপোড়ে প্রস্তুত করিয়াও পরিয়া থাকে বিলাতি কলের থানফাড়া ধুতি; কাপড় সুতায় শুষ্ক বসিল, সে ধুতির উপর চাদর জুটা ভার হইবে। অনেকের ধূতিও জুটিবে না; লঙ্গটিতে লজ্জা নিবারিত যদি হইবার হন তবেই হইবেন, নহিলো লজ্জা