পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RGO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী । বারেক স্মরণীয়। বিলাতি সূত্ৰ-শুঙ্কে দেশী কাপড়ের উন্নতিকল্পনা আকাশকুসুমেরই অন্তর্গত। বিগত মার্চের ট্যারিফট্যাজে অনেকানেক দ্রব্যের উপরেই আমদানিমাশুল বসিয়াছে। কিন্তু এখনও কতক দ্রব্য আছে, যাহাদের উপর হয়তো মাশুল বসে নাই; অথচ মূল্য তাঁহাদের বাড়িয়াছে। বাজারে যে দ্রব্যই দর করা সবই মহাৰ্য; বানিয়া বলে “মহাশয় মাশুল বসিয়াছে; কাজেই মহার্ঘ্য'।ইহা বানিয়ার চাতুরী অথবা ট্যারিফ তহশীলদারদের বাহাদুরি ঠিক বলা যায় না। তবে ট্যারিফের নিয়ম গঠনেও যে গলদ আছে ইহাও নিশ্চয়। আইনের উপস্থিত সংশোধনে সে দোষ দূরীভূত হইলেও হইতে পারে। কিন্তু কেবল করদ দ্রব্যের দুর্বোধ্য ও অনির্দিষ্ট শ্রেণী বাঁধিয়া দিলেই চলিবে না। পরন্তু কেবল ইন্ডিয়া গেজেটে ট্যারিফের নিয়মাবলী প্ৰকাশিত করিয়া তাহা বড়ো বড়ো বন্দরে প্রেরণ করা প্রচুর নহে। কোন কোন দ্রব্যের উপর আমদানি মাশুল বসিল তাহা নির্দিষ্ট ও পরিষ্কারভাবে দেশীয় ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় লিখিয়া সর্বসাধারণের বিদিতাৰ্থে বাজারে । প্রচার করা উচিত। নহিলে বিক্রেতা ক্রেতা উভয়েরই সংকট। এ বিষয়ে যে কেবল বড়ো বড়ো সওদাগরেরাই সংশ্লিষ্ট তাহা নহে। ক্ষুদ্র দোকানী পসারী ও দ্রব্যের খরচকারী ক্রেতা মাত্ৰেই ইহার সহিত জড়িত। অতএব অর্থসচিব শ্ৰীযুক্ত ওয়েস্টল্যান্ড বাহাদুর যে কেবল ইন্ডিয়া গেজেটের উপরেই নির্ভর করিতেছেন, ইহা ঠিক নহে। গত মার্চ মাসে অনেকানেক আমদানি দ্রব্যের উপরেই মাশুল বসিয়াছিল; বসে নাই কেবল কাপড় ও সুতার উপরে। মাঞ্চিস্টারের মাহায়েই হউক কিংবা অন্য যে কারণেই হউক, সম্ভবত মাঞ্চিস্টারের মহিমাতেই, সেক্রেটারি-অব-স্টেট কাপড় সুতার মাশুল অনুমোদন করেন নাই। নহিলে ইন্ডিয়া গবর্নমেন্টের তাহাতে সবিশেষ ইচ্ছা না ছিল এমন নহে। স্টেট-সেক্রেটারি মি. ফাউলার সাহেবকে তাহার উক্ত অনভিমতের জন্য অনেক নিন্দা তিরস্কার ও লাঞ্ছনার ভাগী হইতে হইয়াছিল। কাউন্সিলের প্রায় সকল মেম্বরই তাহার প্রতি কুটিল কটাক্ষা করিয়াছিলেন। সরকারি সদস্যেরা সাফই বলিয়াছিলেন যে, তাহারা হুকুমের চাকর সুতরাং কাপড় সূতার কর বসাইতে পারিলেন না। পরন্তু সাহেব সওদাগরেরা সাংঘাতিক রুষ্ট হইয়া উঠিয়াছিলেন; একটা অস্বাভাবিক আন্দোলন উঠাইয়াছিলেন। নোটিব পেটিয়টেরা যাইয়া সে আন্দোলনে যেরূপে যোগ দেন অগ্ৰে উল্লেখ করিয়াছি। কাপড় সূতার কারের অভিলাষে আন্দোলন ভয়ানক ফাপিয়া উঠে। দেশীয় স্বদেশহিতৈষী ও সম্পাদকবর্গ একবাক্যে বলিয়া উঠেন- "ইহা ইংরাজের একান্ত অন্যায়, অপরিসীম অবিচার, পৈশাচিক অত্যাচার; সুতা ও কাপড়ের কর অবিলম্বে চাই, এখনই চাই; নহিলে দেশ। এই দণ্ডেই উৎসক্সে যাইবে।” আশ্চর্য! আমরা এরূপ আশ্চৰ্য আন্দোলন ও অভিমত খুব কমই দেখিয়াছি। ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী লোক, সর্ববিষয়ে স্বতন্ত্র পথানুসারী সংবাদপত্র, এ সম্বন্ধে সকলেরই এক রায়‘কাপড় সূতার কর না বসিলে অচিরাৎ অধঃপাতে যাইবে।” ঘোরতর কংগ্রেস-বাদী ‘বেঙ্গলী’ হইতে কংগ্রেসের বিকট বিদ্বেবী “বঙ্গবাসী’ পর্যন্ত উভয় শ্রেণীর স্বদেশভক্তই, এ ক্ষেত্রে একাসনে উপবিষ্ট! তৈলে জলে দুগ্ধ শর্করাবৎ সংমিশ্রণ! অর্থনৈতিক সমস্যায়। এরাপ অস্বাভাবিক একাকার আমরা আর কখনো দেখি নাই। এরাপ প্ৰকাণ্ড প্ৰমাদও আর কখনো দেখি নাই। আন্দোলনের তুফান উঠিল। কয়েক মাস ধরিয়া আরজি ও আবেদনের ফুটকড়াই ছুটিল। সহস্ৰ সহস্ৰ স্বাক্ষরপূর্ণ সুদীর্ঘ আবেদন বিলাতে প্রেরিত হইল। স্বাক্ষর গ্রহণের সীমা ছিল না; দিগবিদিগবিচার ছিল না; অজ্ঞানে সজ্ঞানে যেমনেই হউক। দস্তখত হইলেই হইল। দস্তখত সংগ্রহের জন্য দস্তুর মতো কমিশন কবুল করিয়া লোক নিযুক্ত হইয়াছিল। শুনিয়াছি কোনো পেট্রিয়ট তাহার আপিসের পবিত্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া এই সৎকাৰ্য সম্পাদনা করিয়াছিলেন! ওয়েস্টল্যান্ডের ইন্ডিয়া কাউন্সিলের বক্তৃতা : ১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৪।