পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ひぐ রবীন্দ্র-রচনাবলী হবার সম্ভাবনা যে তার নেই তা বলতে পারি। নে ৷” “তোমার ভবিষ্যৎ ঠিকানাটা ?” “হুকুম নেই বলবার ” “তা হলে কি কল্পনাও করতে পারব না। তুমি আছ কোথায় ?” “ইতিমধ্যে ঝুলির ভিতর থেকে বইগুলো বের করে এলা উলটেপালটে দেখছে। কাব্য, তার কিছু ইংরেজি, আর দুই-একখানা বাংলা । অতীন বললে, “এতদিন ওগুলো বয়ে বেড়িয়েছি পাছে নিজের জাত ভুলি। ওরই বাণীলোকে ছিল আমার আদি বসতি। পাতা খুললেই পেনসিলে চিহ্নিত তার রাস্তা-গলির নির্দেশ পাবে। আর আক্ত । এই দেখো চেয়ে ।” এলা হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে অতীনের পা জড়িয়ে ধরলে ; বললে, “মাপ করো, অন্তু, আমাকে মাপ, করো ।” “তোমাকে মাপ করবার কী আছে এলী ? ভগবান যদি থাকেন, তার যদি থাকে অসীম দয়া, তবে তিনি যেন আমাকে মাপ করেন ।” “যখন তোমাকে চিনতুম না তখন তোমাকে এই রাস্তায় দাড় করিয়েছি।” অতীন হেসে উঠে বললে, “নিজেরই পাগলামির ফুল-স্টমে এই অস্থানে পীেচেছি সে খ্যাতিটুকুও দেবে না। আমাকে ? আমাকে নাবালকের কোঠায় ফেলে অভিভাবকাগিরি করতে এলে আমি সাইব না। বলে রাখছি। তার চেয়ে মঞ্চ থেকে নেবে এসো ; আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলো— এসে এসে বঁধু এসো, আধো আঁচরে বোসে । “হয়তো বলতুম কিন্তু আজ তুমি এমন করে খেপে উঠলে কেন ?” “খেপিব না ? বললে কিনা ভুজমৃণালের জোরে তুমি আমাকে পথে বের করেছ!” “সত্যি কথা বললে রাগ কর কেন ?” “সত্যি কথা হল ? আমি ছিটকে পড়েছি রাস্তায় অন্তরের বেগে, তুমি উপলক্ষ মাত্র । অন্য কোনো শ্রেণীর বঙ্গমহিলাকে উপলক্ষ পেলে এতদিনে গোরা-কলা-সম্মিলনী ক্লাবে ব্রিজ খেলতে যে তুম, ঘোড়দৌড়ের মাঠে গবর্নরের বক্সের অভিমুখে স্বৰ্গারোহণপর্বের সাধনা করতুম। যদি প্রমাণ হয় আমি মূঢ়, তবে জাক করে বলব, সে মৃঢ়তা স্বয়ং আমারই, যাকে বলে ভগবদত্ত প্রতিভা ।” “অন্তু, দোহাই তোমার, আর বাজে বকুনি বোকো না । তোমার জীবিকা আমিই ভাসিয়ে দিয়েছি, এ দুঃখ কখনো ভুলতে পারব না। দেখতে পাচ্ছি। তোমার জীবনের মূল গেছে। ছিন্ন হয়ে ।” “এতক্ষণে সেই মেয়ের প্রকাশ হল, যে-মেয়েটি রিয়াল। একটুকুতেই ধরা পড়ে দেশোদ্ধারের রঙ্গমঞ্চে তুমি রোম্যান্টিক | যে-সংসারে কাসার থালায় দুধ-ভাত মাছের মুড়ো তারই কেন্দ্রে বসে আছ তালপাতার পাখা হাতে। যেখানে পোলিটিক্যাল ঠাঙার গুতি সেখানে আলুথালু চুলে চােখদুটি পাকিয়ে এসে পড় অপ্রকৃতিস্থতার ঝোকে, সহজবুদ্ধি নিয়ে নয়।” “এত কথাও বলতে পাের, অন্তু, মেয়েমানুষও তোমার কাছে হার মানে ৷” “মেয়েমানুষ কথা বলতে পারে নাকি ! তারা তো শুধু বকে । কথার টর্নেডো দিয়ে সনাতন মূঢ়তার ভিত ভাঙব বলে একদিন মনের মধ্যে ঝোড়ো মেঘ জমে উঠেছিল। সেই মূঢ়তার উপরেই তোমাদের জয়স্তম্ভ গাথতে বেরিয়েছ। কেবল গায়ের জোরে ।” A. “তোমার পয়ে পড়ি, আমাকে বুঝিয়ে দাও আমার ভুলে তুমি কেন ভুল করলে ? কেন নিলে জীবিকাবর্জনের দুঃখ ?” ) . “ওটা আমার ব্যঞ্জনা, ইংরেজিতে যাকে বলে জেসচার। ওটা আমার নিদেনকালের ভাষা। যদি দুঃখ না মানতুম তা হলে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে, কিছুতে বুঝতে না তোমাকে কতখানি ভালোবেসেছি। সেই কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বোলো না। ওটা দেশকে ভালোবাসে।”