পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় 8ひふ অঙ্গ। এতে খ্রীস্টকে ব্যঙ্গ করা হয় ।” “কী হয়েছে তোমার অস্তু ! কোন ক্ষোভের মুখে এসব কথা বলছ ? তুমি কি বলতে চাও কর্তব্যকে কর্তব্য বলে মানা যায় না। অরুচি কাটিয়ে দিয়েও ?” “রুচির কথা হচ্ছে না এলী, স্বভাবের কথা । শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে বীরের কর্তব্যই করতে বলেছিলেন অত্যন্ত অরুচি সত্ত্বেও ; কুরুক্ষেত্র চাষ করবার উদ্দেশে এগ্রিকালচারাল ইকনমিকস চর্চা করতে বলেন 负 ” “শ্ৰীকৃষ্ণ তোমাকে হলে কী বলতেন, অন্তু ?” “অনেকদিন আগেই কনে-কানে বলে রেখেছেন । সেই তার কানে-কানে কথাটাকে মুখ খুলে বলবার ভার ছিল আমার পরে | নির্বিচারে সবারই একই কর্তব্য, গুরুমশায় কানে ধরে এই কথাটা বলতেই এত কৃত্রিমতার সৃষ্টি হয়েছে! তোমাকে মুখের উপরই বলছি। ওদের যে-পাড়ায় অহংকার করে নম্রতা করতে যাও সেখানে তোমারও জায়গা নেই। দেবী ! সবাই দেবী তোমরা ! নকল দেবীর কৃত্রিম সাজ, মেয়েদের অন্য সাজেরই মতো, পুরুষ-দর্জির দোকানো বানানো ।” “দেখো অস্তু, আজও বুঝতে পারি। নে যে-পথ তোমার নয়, সে-পথ থেকে কেন তুমি জোর করে ফিরে আস নি ?” “তা হলে বলি । অনেক কথা জানতুম না, অনেক কথা ভাবি নি এই পথে প্রবেশ করবার আগে । একে একে এমন সব ছেলেকে কাছে দেখলুম, বয়সে যারা ছোটাে না হলে যাদের পায়ের ধুলো নিতুম । তারা চোখের সামনে কী দেখেছে কী সয়েছে, কী অপমান হয়েছে তাদের, সে-সব দুর্বিষহ কথা কোথাও প্রকাশ হবে না । এরই অসহ্য ব্যথায় আমাকে খেপিয়ে তুলেছিল । বারবার মনে মনে প্ৰতিজ্ঞা করেছি, ভয়ে হার মানব না, পীড়নে হার মানব না, পাথরের দেয়ালে মাথা ঠুকে মরব। তবু তুড়ি মেরে উপেক্ষা করব সেই হৃদয়হীন দেয়ালটাকে ৷” “তার পরে কি তোমার মত বদলে গৈল ?” “শোনো আমার কথা | শক্তিমানের বিরুদ্ধে যে লড়াই করে, সে উপায়বিহীন হলেও সেই শক্তিমানের সমকক্ষে দাঁড়ায় ; তাতে তার সম্মান রক্ষা হয় । সেই সম্মানের অধিকার আমি কল্পনা করেছিলুম। দিন যতই এগোতে থাকল চােখের সামনে দেখা গেল— অসাধারণ উচ্চ মনের ছেলে অল্পে অল্পে মনুষ্যত্ব খোয়াতে থাকল। এতবড়ো লোকসান আর কিছুই নেই। নিশ্চিত জানতুম আমার কথা হেসে উড়িয়ে দেবে, রেগে বিদ্যুপ করবে, তবু ওদের বলেছি অন্যায়ে অন্যায়কারীর সমান হলেও তাতে হার, পরাজয়ের আগে মরবার আগে প্রমাণ করে যেতে হবে আমরা ওদের চেয়ে মানবধর্মে বড়ো— নইলে এতবড়ো বলিষ্ঠের সঙ্গে এমনতরো হারের খেলা খেলছি কেন ? নিৰ্বদ্ধিতার আত্মঘাতের জন্যে ?— আমার কথা ওদের কেউ বোঝে নি। তা নয় । কিন্তু কতজনই বা ” “তখনো ওদের ছাড়লে না কেন ?” “আর কি ছাড়তে পারি ? তখন যে শাস্তির নিষ্ঠুর জাল সম্পূৰ্ণ জড়িয়ে এসেছে ওদের চার দিকে । ওদের ইতিহাস নিজে দেখলুম, বুঝতে পেরেছি। ওদের মর্মান্তিক বেদনা, সেইজন্যেই রাগই করি আর ঘূণাই করি, তবু বিপন্নদের ত্যাগ করতে পারি নে। কিন্তু একটা কথা এই অভিজ্ঞতায় সম্পূর্ণ বুঝেছি, করলে আন্তরিক দুৰ্গতি শোচনীয় হয়ে ওঠে। রোগ সব শরীরেই দুঃখের কিন্তু ক্ষীণ শরীরে মারাত্মক । মনুষ্যত্বের অপমান করেও কিছুদিনের মতো জয়ডঙ্কা বাজিয়ে চলতে পারে তারা যাদের আছে বাহুবল, কিন্তু আমরা পারব না। আগাগােড়া কলঙ্কে কালো হয়ে পরাভবের শেষসীমায় অখ্যাতির অন্ধকারে মিশিয়ে যাব আমরা ।” "কিছুকাল থেকে এই ভয়ংকর ট্র্যাজেডির চেহারা আমার কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অস্তু। গৌরবের আহবানে নেমেছিলেম। কিন্তু লজ্জা বেড়ে উঠছে প্রতিদিন । এখন আমরা কী করতে পারি বলে আমাকে ৷”