পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

丽3冈 ' 8) নিবারণ করিবার এক আদেশপত্র আপনার সেনাপতির নিকট পঠাইয়া দিন । ওপারে এতক্ষণে ঘোর যুদ্ধ বাধিয়া গেছে।” কতকগুলি সৈন্য-সহিত দূতের হস্তে আদেশপত্ৰ পাঠানো হইল। অষ্টম পরিচ্ছেদ অতি প্রত্যুষেই অন্ধকার দূর হইতে না হইতেই যুবরাজ ও ইন্দ্ৰকুমার দুই ভাগে পশ্চিমে ও পূর্বে মগদিগকে আক্রমণ করিতে চলিয়াছেন । সৈন্যের অল্পতা লইয়া রূপনারায়ণ হাজারি দুঃখ করিতেছিলেন- তিনি বলিতেছিলেন- আর পাচ হাজার লইয়া আসিলেই আর ভাবনা ছিল না । ইন্দ্ৰকুমার বলিলেন, “ত্রিপুরারির অনুগ্রহ যদি হয় তবে এই কয়জন সৈন্য লইয়াই জিতিব, আর যদি না হয় তবে বিপদ আমাদের উপর দিয়াই যাক, ত্রিপুরাবাসী যত কম মরে ততই ভালো । কিন্তু হরের কৃপায় আজ আমরা জিতিবই।” এই বলিয়াই হর হর বােম বােম রব তুলিয়া কৃপাণ বর্শ লইয়া ঘোড়ায় চড়িয়া বিপক্ষদের অভিমুখে ছুটলেন— তাহার দীপ্ত উৎসাহ তাহার সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল । গ্ৰীষ্মকালে দক্ষিন বাতাসে খড়ের চালের উপর দিয়া আগুন যেমন ছোটে তাহার সৈন্যেরা তেমনি ছুটিতে লাগিল। কেহই তাঁহাদের গতিরোধ করিতে পারিল না । বিপক্ষদের দক্ষিণ দিকের ব্যুহ ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল। হাতাহাতি যুদ্ধ বাধিল । মানুষের মাথা ও দেহ কটা-শস্যের মতো শস্যক্ষেত্রেয় উপর গিয়া পড়িতে লাগিল। ইন্দ্ৰকুমারের ঘোড়া কাটা পড়িল । তিনি মাটিতে পড়িয়া গেলেন ; রুব উঠিল। তিনি মারা পডিয়াছেন । কুঠারাঘাতে এক মগ আশ্বারোহীকে অশ্বচ্যুত করিয়া ইন্দ্ৰকুমার তৎক্ষণাৎ তাহার ঘোড়ার উপর চড়িয়া বসিলেন | রেকবের উপর দাড়াইয়া তাহার রক্তাক্ত তলোয়ার দ্বিগুণ জুলিয়া উঠিল। এই-সকল ব্যাপার দেখিয়া মগদিগের বাম দিকের ব্যুহের সৈন্যগণ আক্রমণের প্রতীক্ষণ ? না করিয়া সহসা বাহির হইয়া যুবরাজের সৈন্যের উপর গিয়া পড়িল। যুবরাজের সৈন্যগণ সহসা এরূপ আক্রমণ প্রত্যাশা করে নাই ! তাহারা মুহুর্তের মধ্যে বিশৃঙ্খল হইয়া পড়িল । তাহদের নিজের অশ্ব নিজের পদাতিকদের উপর গিয়া পড়িল, কোন দিকে যাইবে ঠিকানা পাইল না । যুবরাঞ্জ ও ইশা খাঁ অসমসাহসের সহিত সৈন্যদের সংযত করিয়া লইতে প্রাণপণ চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না । অদূরে রাজধরের সৈন্য লুক্কায়িত আছে কল্পনা করিয়া সংকেতস্বরূপ বার বার তুরানিনাদ করিলেন। কিন্তু রাজধরের সৈন্যের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাইল না । ইশা খৃঃ বলিলেন, “তঁহাকে ডাকা বৃথা । সে শৃগাল, দিনের বেলা গর্ত হইতে বাহির হইবে না৷ ” ইশা খা ঘোড়া হইতে মাটিতে লাফাইয়া পড়িলেন । পশ্চিম মুখ হইয়া সত্বর নামাজ পড়িয়া লইলেন । মরিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া মরিয়া হইয়া লড়িতে লাগিলেন । চারি দিকে মৃত্যু যতই ঘেরিতে লাগিল, দুৰ্দান্ত যৌবন এমন সময় ইন্দ্ৰকুমার শত্রুদের এক অংশ সম্পূর্ণ জয় করিয়া ফিরিয়া আসিলেন । আসিয়া দেখিলেন যুবরাজের একদল অশ্বারোহী সৈন্য ছিন্নভিন্ন হইয়া পালাইতেছে, তিনি তাহাদিগকে ফিরাইয়া লাইলেন । বিদ্যুদবেগে যুবরাজের সাহায্যার্থে আসিলেন। কিন্তু সে বিশৃঙ্খলার মধ্যে কিছুই কুলকিনারা পাইলেন না। ঘূর্ণ বাতাসে মরুভূমির বালুকরোশি যেমন ঘুরিতে থাকে, উপত্যকার মাঝখানে যুদ্ধ তেমনই পাক খাইতে লাগিল। রাজধরের সাহায্য প্রার্থনা করিয়া বার বার তুরীধ্বনি উঠিল, কিন্তু তাহার উত্তর পাওয়া গেল না । সহসা কী মন্ত্রবলে সমস্ত থামিয়া গেল, যে যেখানে ছিল স্থির হইয়া দাড়াইল- আহতের আর্তনাদ ও অশ্বের হ্যেষা ছাড়া আর শব্দ রহিল না। সন্ধির নিশান লইয়া লোক আসিয়াছে। মগদের রাজা পরাজয় স্বীকার করিয়াছেন। হর হর বোম বোমা শব্দে আকাশ বিদীর্ণ হইয়া গেল। মগ-সৈন্যগণ আশ্চর্য হইয়া পরস্পরের মুখ চাহিতে লাগিল ।