পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধম 8VS আমি সম্পূর্ণ নিভৃতে— একান্তনির্জনে রহিয়াছি— শান্তি এবং বিরামের সীমা নাই। এমন সম্ভব হইল কী করিয়া ? ইহার কারণ : বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ নহিলে এই জগৎ, যাহা বিচিত্র, যাহা অগণ্য, যাহার প্রত্যেক কণা-কণিকাটিও কম্পিতঘূর্ণিত, তাহা কী ভয়ংকর। বৈচিত্ৰ্য যদি এক-বিরহিত হয়, অগণতা যদি একসূত্রে গ্রথিত না হয়, উদ্যত শক্তিসকল যদি স্তব্ধ একের দ্বারা ধৃত হইয়া না থাকে, তবে তাহা কী করাল, তবে বিশ্বসংসার কী অনির্বচনীয় বিভীষিকা। তবে আমরা দুর্ধর্ষ জগৎপুঞ্জের মধ্যে কাহার বলে এত নিশ্চিন্ত হইয়া আছি ? এই মহা-অপরিচিত, যাহার প্রত্যেক কণাটিও আমাদের কাছে দুর্ভেদ্য রহস্য, কাহার বিশ্বাসে আমরা ইহাকে চিরপরিচিত মাতৃক্ৰোড়ের মতো অনুভব করিতেছি। এই-যে আসনের উপর আমি এখনই বসিয়া আছি, ইহার মধ্যে সংযোজন-বিযোজনের যে মহাশক্তি কাজ করিতেছে, তাহা এই আসন হইতে আরম্ভ করিয়া সূর্যলোক-নক্ষত্ৰলোক পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন-অখণ্ড ভাবে চলিয়া গেছে, তাহা যুগযুগান্তর হইতে নিরন্তরভাবে লোকলোকান্তরকে পিণ্ডীকৃত-পৃথককৃত করিতেছে, আমি তাহারই ক্রোড়ের উপর নির্ভয়ে আরামে বসিয়া আছি, তাহার ভীষণ সত্তাকে জানিতেও পারিতেছি না- সেই বিশ্বব্যাপী বিরাট ব্যাপার আমার বিশ্রামের লেশমাত্র ক্ষতি করিতেছে না। ইহার মধ্যে আমরা খেলিতেছি, গৃহনির্মাণ করিতেছি— এ আমাদের কে ? ইহাকে প্রশ্ন করিলে, এ কোনোই উত্তর দেয় না । ইহা দিকে-দিকে আকাশ হইতে আকাশান্তরে নিরুদ্দেশ হইয়া শতধা-সহস্রধা চলিয়া গেছে— এই মুক মূঢ় মহাবাহুরূপীর সঙ্গে কে আমাদের এমন প্রিয়, পরিচিত আত্মীয়সম্বন্ধ বাধিয়া দিয়াছেন ? তিনি— যিনি, বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি डिलेडाकg | এই এককে আমরা বিশ্বের বৈচিত্র্যের মধ্যে সুন্দর এবং বিশ্বের শক্তির মধ্যে শান্তিস্বরূপে দেখিতেছি, তেমনি মানুষের সংসারের মধ্যে সেই স্তব্ধ একের ভাবটি কী ? সেই ভাবটি মঙ্গল । এখানে আঘাত-প্ৰতিঘাতের সীমা নাই, এখানে সুখদুঃখ বিরহমিলন বিপৎসম্পদ লাভক্ষতিতে সংসারের সর্বত্র সৰ্বক্ষণ বিক্ষুব্ধ হইয়া আছে। কিন্তু এই চাঞ্চল্য এই সংগ্রামের মধ্যে সেই এক নিয়ত স্তব্ধ হইয়া আছেন বলিয়া সংসার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না। সেইজন্যে নানা বিরোধবিদ্বেষের মধ্যেও পিতামাতার সহিত পুত্র, ভ্রাতার সহিত'ভ্ৰাতা, প্রতিবেশীর সহিত প্রতিবেশী, নিকটের সহিত দূর, প্রত্যহ প্রতিমুহূর্তেই গ্রথিত হইয়া উঠিতেছে | সেই ঐক্যজােল আমরা ক্ষণিকের আক্ষেপে যতই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিতেছি, ততই তাহা আপনি জোড়া লাগিয়া যাইতেছে । যেমন খণ্ডভাবে আমরা জগতের মধ্যে অসংখ্য কদৰ্যত দেখিতে পাই, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও সমস্ত জগৎ মহাসৌন্দর্যে প্রকাশিত— তেমনি খণ্ডভাবে সংসারে পাপতাপের সীমা নাই, তথাপি সমস্ত সংসার অবিচ্ছিন্ন মঙ্গলসূত্রে চিরদিন ধূত হইয়া আছে। ইহার অংশের মধ্যে কত অশান্তি, কত অসামঞ্জস্য দেখিতে পাই, তবু দেখি, ইহার সমগ্রের মঙ্গল-আদর্শ কিছুতে নষ্ট হয় না। সেইজন্য মানুষ সংসারকে এমন সহজে আশ্রয় করিয়া আছে। এত বৃহৎ লোকসংঘ, এত অসংখ্য অনান্তীয়, এত প্রবল স্বার্থসংঘাত, তবু এ সংসার রমণীয়, তবু ইহা আমাদিগকে রক্ষা ও পালন করিবার চেষ্টা করে, নষ্ট করে না ! ইহার দুঃখতাপও মহামঙ্গলসংগীতের একতানে অপূর্ব ছন্দে মিলিত হইয়া উঠিতেছে— কেননা, বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ । . আমরা আমাদের জীবনকে প্রতিক্ষণে খণ্ড খণ্ড করি বলিয়াই সংসারতাপ দুঃসহ হয় । সমস্ত ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্নতাকে সেই মহান একের মধ্যে গ্রথিত করিতে পারিলে সমস্ত আক্ষেপ বিক্ষেপের হাত হইতে পরিত্রাণ পাই । সমস্ত হৃদয়বৃত্তি সমস্ত কর্মচেষ্টাকে তাহার দ্বারা সমাচ্ছন্ন করিয়া দেখিলে কোন বাধায় আমার অধীরতা, কোন বিঘ্নে আমার নৈরাশ্য, কোন লোকের কথায় আমার ক্ষোভ, কোন ক্ষমতায় আমার অহংকার, কোন বিফলতায় আমার গ্লানি ! তাহা হইলেই আমার সকল কর্মের মধ্যেই ধৈর্য ও শান্তি, সকল হৃদবৃত্তির মধ্যেই সৌন্দর্য ও মঙ্গল উদ্ভাসিত হয়, দুঃখতাপ পুণ্যে বিকশিত এবং সংসারের সমস্ত আঘাতবেদনা মাধুর্যে উচ্ছসিত হইয়া উঠে। তখন সর্বত্র সেই স্তব্ধ একের মঙ্গলবন্ধন অনুভব করিয়া সংসারে দুঃখের অস্তিত্বকে দুর্ভেদ্য প্ৰহেলিকা বলিয়া গণ্য করি না— দুঃখের মধ্যে, শোকের মধ্যে, অভাবের মধ্যে নতমস্তকে তঁহাকেই স্বীকার করি— যাহার মধ্যে যুগযুগান্তর হইতে সমস্ত