পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ዓ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইচ্ছাকে যখন তাহার মধ্যে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাই, তখন অন্তত ক্ষণকালের জন্যও জানিতে পারি।-- কিসের প্রতি আমার যথার্থ ভক্তি, কী আমার অন্তরের আকাঙক্ষা । তখন আরো একটা কথা বোঝা যায়। ইহা, বুঝিতে পারি যে, যে-সমস্ত ইচ্ছা প্রতিক্ষণে আমার সার্থকতালাভের প্রার্থনাকে বাধা দিতেছে, স্মৃতি দিতেছে না, তাহাকে কেবলই আমার চেতনার অন্তরালবতী, আমার চেষ্টার বহির্গত করিয়া রাখিয়াছে । আর, যাহার কথা বলিতেছি, তাহার পক্ষে ঠিক ইহার বিপরীত | যে-মঙ্গল-ইচ্ছা, যে সার্থকতার ইচ্ছা বিশ্বমানবের মজাস্বরূপ, যাহা মানব সমাজের মধ্যে চিরদিনই অকথিত বাণীতে এই মন্ত্র গান করিতেছে— অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতিৰ্গময়, মৃতোর্মামৃতং গময়— এই ইচ্ছাই তাহার কাছে সর্বাপেক্ষা প্ৰত্যক্ষ, আর সমস্ত ইচ্ছা ছায়ার মতো তাহার পশ্চাদ্বতী, তাহার পদতলগত । তিনি জানেন- সত্য, আলোক, অমৃতই চাই, মানুষের ইহা না হইলেই নয়, অন্নবস্ত্ৰ-ধনমানকে তিনি ক্ষণিক ও আংশিক আবশ্যক বলিয়াই জানেন । বিশ্বমানবের অন্তনিহিত এই ইচ্ছাশক্তি তাহার ভিতর দিয়া জগতে প্ৰত্যক্ষ হয় বলিয়া, প্রমাণিত হয় বলিয়াই তিনি চিরকালের জন্য মানবের সামগ্ৰী হইয়া উঠেন । ইচ্ছাকে আমাদের যে-জীবনের মধ্যে প্রতিফলিত করিতে পারি না, মানবসমাজে সে-জীবনের ক্ষণিক-মূল্য ক্ষণকালের মধ্যেই নিঃশেষ হইয়া যায়। কিন্তু মহাপুরুষদের দৃষ্টান্ত আনিলে একটা ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা থাকে | মনে হইতে পারে যে, ক্ষমতাসাধ্য প্রতিভাসাধ্য কর্মের দ্বারাতেই বুঝি মানুষ সত্য, আলোক ও অমৃতানুসন্ধানের পরিচয় দেয়। তাহা কোনোমতেই নহে। তাহা যদি হইত, তবে পৃথিবীর অধিকাংশ লোক অমৃতের আশামাত্র করিতে পারিত না । যাহা সাধারণ বুদ্ধিবল-বাহুবলের পক্ষে দুঃসাধ্য, তাহাতেই প্রতিভা বা অসামান শারীরিক শক্তির প্রয়োজন ; কিন্তু সত্যকে অবলম্বন করা, আলোককে গ্রহণ করা, অমৃতকে বরণ করিয়া লওয়া, ইহা কেবল একান্তভাবে, যথার্থভাবে ইচ্ছার কর্ম। ইহা আর কিছু নয়- যাহা কাছেই আছে, তাহাকেই পাওয়া । ইহা মনে রাখিতে হইবে, আমাদিগকে যাহা-কিছু দিবার তাহা আমাদের প্রার্থনার বহুপূর্বেই দেওয়া হইয়া গৈছে । আমাদের যথার্থ ঈপ্সিতধনের দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত । বাকি আছে কেবল লইবার চেষ্টা- তাহাঁই যথার্থ প্রার্থনা | ঈশ্বর এইখানেই আমাদের গীেরব রক্ষা করিয়াছেন । তিনিই সব দিয়াছেন, অথচ এটুকু আমাদের বলিবার মুখ রাখিয়াছেন যে, আমরাই লইয়াছি। এই লওয়াটাই সফলতা, ইহাই লাভ— পাওয়াট সকল সময়ে লাভ নহে— তাহা অধিকাংশস্থলেই পাইয়াও না-পাওয়া, অবশিষ্টস্থলে বিষম একটা বোঝা । আর্থিক-পারমার্থিক সকল বিষয়েই এ কথা খাটে | ঋষি বলিয়াছেন আবিরাবীমা এধি | হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকট প্রকাশিত হও । তুমি তো স্বপ্রকাশ, আপনা-আপনি প্রকাশিত আছই, এখন, আমার কাছে প্রকাশিত হও, এই আমার প্রার্থনা | তোমার পক্ষে প্রকাশের অভাব নাই, আমার পক্ষে সেই প্রকাশ উপলব্ধির সুযোগ বাকি আছে। যতক্ষণ আমি তোমাকে না দেখিব, ততক্ষণ তুমি পরিপূর্ণ প্রকাশ হইলেও আমার কাছে দেখা দিবে না। সূর্য তো আপন আলোকে আপনি প্রকাশিত হইয়াই আছেন, এখন আমারই কেবল চোখ খুলিবার, জাগ্রত হইবার অপেক্ষা । যখন আমাদের চােখ খুলিবার ইচ্ছা হয়, আমরা চােখ খুলি, তখন সূৰ্য আমাদিগকে নূতন করিয়া কিছু দেন না, তিনি যে আপনাকে আপনি দান করিয়া রাখিয়াছেন, ইহাই আমরা মুহুর্তের মধ্যে বুঝিতে পারি। অতএব দেখা যাইতেছে — আমরা যে কী চাই, তাহা যথার্থভাবে জানিতে পারাই প্রার্থনার আরম্ভ যখন তাহা জানিতে পারিলাম, তখন সিদ্ধির আর বড়ো বিলম্ব থাকে না, তখন দূরে যাইবার প্রয়োজন