পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8 AA ধর্মের বিশেষ লক্ষ্য হইয়া দাঁড়ায় । অথচ সংসারে একমাত্র যাহা সমস্ত বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য, সমস্ত বিরোধের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু, তাহাকেই ধর্ম বলা যায়। তাহা মনুষ্যত্বের এক অংশে অবস্থিত হইয়া অপর অংশের সহিত অহরহ কলহ করে না— সমস্ত মনুষ্যত্ব তাহার অন্তর্ভুত— তাহাঁই যথার্থভাবে মনুষ্যত্বের ছােটােবড়ো, অন্তর-বাহির সর্বাংশে পূর্ণ সামঞ্জস্য । সেই সুবৃহৎ সামঞ্জস্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে মনুষ্যত্ব সত্য হইতে স্মৃলিত হয়, সৌন্দর্য হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া পড়ে। সেই অমোঘ ধর্মের আদর্শকে যদি গির্জার গণ্ডির মধ্যে নির্বাসিত করিয়া দিয়া অন্য যে-কোনো উপস্থিত প্রয়োজনের আদর্শ দ্বারা সংসারের ব্যবহার চালাইতে যাই, তাহাতে সর্বনাশী অমঙ্গলের সৃষ্টি হইতে থাকে। কিন্তু ভারতবর্ষের এ আদর্শ সনাতন নহে। আমাদের ধর্ম রিলিজন নহে, তাহা মনুষ্যত্বের একাংশ নহে— তাহা পলিটিকস হইতে তিরস্কৃত, যুদ্ধ হইতে বহিষ্কৃত, ব্যবসায় হইতে নির্বাসিত, প্রত্যহিক ব্যবহার হইতে দূরবতী নহে। সমাজের কোনো বিশেষ অংশে তাহাকে প্রাচীরবদ্ধ করিয়া মানুষের দাড়াইয়া নাই | ব্ৰহ্মচর্য গাৰ্হস্থ্য বানপ্ৰস্থ প্রভৃতি আশ্রমগুলি এই ধর্মকেই জীবনের মধ্যে, সংসাবের মধ্যে সৰ্বতোভাবে সার্থক করিবার সোপান | ধর্ম সংসারের আংশিক প্রয়োজন সাধনার জন্য নহে, সমগ্ৰ সংসারই ধর্মসাধনের জন্য । এইরূপে ধর্ম গৃহের মধ্যে গৃহধর্ম, রাজত্বের মধ্যে রাজধর্ম হইয়া ভারতবর্ষের সমগ্র সমাজকে একটি অখণ্ড তাৎপর্য দান করিয়াছিল । সেইজন্য ভারতবর্ষে যাহা অধৰ্ম তাহাই অনুপযোগী ছিল— ধর্মের দ্বারাই সফলতা বিচার করা হইত, অন্য সফলতা দ্বারা ধর্মের বিচার চলিত না । এইজন্য ভারতবর্ষীয় আৰ্যসমাজে শিক্ষার কালকে ব্ৰহ্মচর্য নাম দেওয়া হইয়াছিল । ভারতবর্ষ। জানিত, ব্ৰহ্মলাভের দ্বারা মনুষ্যত্বলাভই শিক্ষা ! সেই শিক্ষা ব্যতীত গৃহস্থতনয় গৃহী, রাজপুত্র রাজা হইতে পারে না । কারণ গৃহকর্মের মধ্য দিয়াই ব্ৰহ্মলাভ, রাজকর্মের মধ্য দিয়াই ব্ৰহ্মপ্রাপ্তি ভারতবর্ষের লক্ষ্য ! সকল কর্ম সকল আশ্রমের সাহায্যেই ব্ৰহ্মউপলব্ধি যখন ভারতবর্ষের চরমসাধনা, তখন ব্ৰহ্মচৰ্যই তাহার শিক্ষা না হইয়া থাকিতে পারে না । যে যাহা যথার্থভাবে চায়, সে তাহার উপায় সেইরূপ যথার্থভাবে অবলম্বন করে । যুরোপ যাহা কামনা করে, বাল্যকাল হইতে তাহার পথ সে প্রস্তুত করে, তাহার সমাজে, তাহার প্রাত্যহিক জীবনে সেই লক্ষ্য জ্ঞাতসারে এবং অজ্ঞাতসারে সে ধরিয়া রাখে । এই কারণেই য়ুরোপ দেশজয় করে, ঐশ্বর্য লাভ করে, প্রাকৃতিক শক্তিকে নিজের সেবাকার্যে নিযুক্ত করিয়া আপনাকে পরম চরিতার্থ জ্ঞান করে। তাহার উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্য আছে বলিয়াই সে সিদ্ধ।কাম হইয়াছে। এইজন্য করিয়া লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য প্ৰস্তুত হইতে থাকে । এককালে আমরা সেইরূপ যথার্থভাবেই ব্ৰহ্মলাভকে যখন চরমলাভ বলিয়া জ্ঞান করিয়াছিলাম, তখন সমাজের সর্বত্রই তাহার যথার্থ উপায় অবলম্বিত হইয়াছিল। তখন যুরোপীয় রিলিজন-চৰ্চার আদর্শকে আমাদের দেশ। কখনোই ধৰ্মলাভের আদর্শ বলিয়া গ্ৰহণ করিতে পারিত না । সুতরাং ধর্মপালন তখন সংকুচিত হইয়া বিশেষভাবে রবিবার বা আর-কোনাে বারের সামগ্ৰী হইয়া উঠে নাই। ব্ৰহ্মচর্য তাহার শিক্ষা ছিল, গৃহাশ্রম তাহার সাধনা ছিল, সমস্ত সমাজ তাহার অনুকুল ছিল— এবং যে ঋষিরা লব্ধ।কাম হইয়া বলিয়া উঠিয়ছিলেন বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তমাদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ যাহারা বলিয়াছেন আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কুতশচন তীহারাই তাহার গুরু ছিলেন । ধর্মকে যে আমরা শৌখিনের ধর্ম করিয়া তুলিব ; আমরা যে মনে করিব, অজস্র ভোগবিলাসের