পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম 8S C দুঃখই তাহার একমাত্র মূলধন । মানুষ সত্যপদার্থ যাহা-কিছু পায় তাহা দুঃখের দ্বারাই পায় বলিয়াই । তাহার মনুষ্যত্ব। তাহার ক্ষমতা অল্প বটে কিন্তু ঈশ্বর তাহাকে ভিক্ষুক করেন নাই। সে শুধু চাহিয়াই কিছু পায় না, দুঃখ করিয়া পায় । আর যত কিছু ধন সে তো তাহার নহে— সে সমস্তই বিশ্বেশ্বরেরকিন্তু দুঃখ যে তাহার নিতান্তই আপনার । সেই দুঃখের ঐশ্বৰ্য্যেই অপূর্ণ জীব পূর্ণস্বরূপের সহিত আপনার গর্বের সম্বন্ধ রক্ষা করিয়াছে, তাহাকে লজ্জা পাইতে হয় নাই। সাধনার দ্বারা আমরা ঈশ্বরকে পাই, তপস্যার দ্বারা আমরা ব্ৰহ্মকে লাভ করি— তাহার অর্থই এই, ঈশ্বরের মধ্যে যেমন পূর্ণতা আছে আমাদের মধ্যে তেমনই পূর্ণতার মূল্য আছে- তাহাই দুঃখ ; সেই দুঃখই সাধনা, সেই দুঃখই তপস্যা, সেই দুঃখেরই পরিণাম আনন্দ মুক্তি ঈশ্বর । আমাদের পক্ষ হইতে ঈশ্বরকে যদি কিছু দিতে হয় তবে কী দিব, কী দিতে পারি ? তাহার ধন তাহাকে দিয়া তো তৃপ্তি নাই— আমাদের একটিমাত্র যে আপনার ধন দুঃখ ধন আছে তাহাই তীহাকে সমর্পণ করিতে হয়। এই দুঃখকেই তিনি আনন্দ দিয়া, তিনি আপনাকে দিয়া পূর্ণ করিয়া দেন— নহিলে তিনি আনন্দ ঢালিবেন কোনখানে ? আমাদের এই আপন ঘরের পাত্রটি না থাকিলে তাহার সুধা তিনি দান করিতেন। কী কবিয়া ? এই কথাই আমরা গীেরব করিয়া বলিতে পারি। দানেই ঐশ্বর্যের পূর্ণতা ? হে ভগবান, আনন্দকে দান করিবার বর্ষণ করিবার প্রবাহিত করিবার এই যে তোমার শক্তি ইহা তোমার পূর্ণতারই অঙ্গ। আনন্দ আপনাতে বদ্ধ হইয়া সম্পূৰ্ণ হয় না, আনন্দ আপনাকে ত্যাগ করিয়াই সার্থক— তোমার সেই আপনাকে দান করিবার পরিপূর্ণতা আমরাই বহন করিতেছি, আমাদের দুঃখের দ্বারা বহন করিতেছি, এই আমাদের বড়ো অভিমান ; এইখানেই তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি, এইখনেই তোমার ঐশ্বর্ষে আমার ঐশ্বর্যে যোগ— এইখানে তুমি আমাদের অতীত নহ, এইখানেই তুমি আমাদের মধ্যে নামিয়া আসিয়াছ ; তুমি তোমার অগণ্য গ্রহসূর্যনক্ষত্ৰ-খচিত মহাসিংহাসন হইতে আমাদের এই দুঃখের জীবনে তোমার লীলা সম্পূর্ণ করিতে আসিয়াছ। হে রাজা, তুমি আমাদের দুঃখের রাজা ; হঠাৎ যখন অর্ধরাত্রে তোমার রথচক্রের বীজগর্জনে মেদিনী বলির পশুর হৃৎপিণ্ডের মতাে কঁপিয়া উঠে তখন জীবনে তােমার সেই প্রচণ্ড আবির্ভাবের মহাক্ষণে যেন তােমার জয়ধ্বনি করতে পারি, হে দুঃখের ধন, তোমাকে চাহি না এমন কথা সেদিন যেন ভয়ে না বলি ; সেদিন যেন দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তোমাকে ঘরে প্রবেশ করিতে না হয়— যেন সম্পূৰ্ণ জাগ্রত হইয়া সিংহদ্বার ধুলিয়া দিয়া তােমার উদ্দীপ্ত ললাটের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া বলিতে পারি, হে দারুণ, তুমিই আমার R | আমরা দুঃখের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া অনেকবার বলিবার চেষ্টা করিয়া থাকি যে আমরা সুখদুঃখকে সমান করিয়া বোধ করিব । কোনো উপায়ে চিত্তকে অসাড় করিয়া ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে সেরূপ উদাসীন হওয়া হয়তো অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু সুখদুঃখ তো কেবলই নিজের নহে, তাহা যে জগতের সমস্ত জীবের সঙ্গে জড়িত। আমার দুঃখবােধ চলিয়া গেলেই তো সংসার হইতে দুঃখ দূর হয় না। অতএব, কেবলমাত্র নিজের মধ্যে নহে, দুঃখকে তাহার সেই বিরাট রঙ্গভূমির মাঝখানে দেখিতে হইবে যেখানে সে আপনার বহ্নির তাপে বজের আঘাতে কত জাতি কত রাজ্য কত সমাজ গড়িয়া তুলিতেছে ; যেখানে সে মানুষের জিজ্ঞাসাকে দুৰ্গম পথে ধাবিত করিতেছে, মানুষের ইচ্ছাকে দুর্ভেদ্য বাঁধার ভিতর দিয়া উদ্ভিন্ন করিয়া তুলিতেছে এবং মানুষের চেষ্টাকে কোনো ক্ষুদ্র সফলতার মধ্যে নিঃশেষিত হইতে দিতেছে না ; যেখানে যুদ্ধবিগ্রহ দুর্ভিক্ষমারী অন্যায় অত্যাচার তাহার সহায় ; যেখানে রক্তসরোবরের মাঝখান হইতে শুভ্ৰ শান্তিকে সে বিকশিত করিয়া তুলিতেছে, দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর তীপের দ্বারা শোষণ করিয়া বর্ষণের মেঘকে রচনা করিতেছে এবং যেখানে হলধরমূর্তিতে সুতীক্ষ ণী:ঙল দিয়া সে মানব-হৃদয়কে বারংবার শত শত রেখায় দীর্ণ বিদীর্ণ করিয়াই তাহাকে ফলবান করিয়া তুলিতেছে। সেখানে সেই দুঃখের হস্ত হইতে পরিত্রাণকে পরিত্রাণ বলে না— সেই পরিত্রাণই মৃত্যু— মুদ্র স্বেচ্ছায় অঞ্জলি রচনা করিয়া যে তাহাকে প্রথম অর্থ না দিয়াছে সে নিজেই বিড়ম্বিত য়াছে ।