পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম ○○述 আত্মাকে মুক্তি দিবার চেষ্টা করিয়াছিল। শরীরকে অপবিত্র বলিয়া পীড়া দিতে চায় নাই, সমাজকে কলুষিত বলিয়া পরিহার করিতে চায় নাই, জীবনকে অনিত্য বলিয়া অবজ্ঞা করিতে চায় নাই— সে সমস্তকেই ব্রহ্মের দ্বারা অখণ্ড-পরিপূর্ণ করিতে চাহিয়াছিল। যুরোপে মানুষের জীবনের দুইটি ভাগ দেখা যায়। এক শেখার অবস্থা- তাহার পরে সংসারের কাজ করিবার অবস্থা | এইখানেই শেষ । কিন্তু কাজ জিনিসটাকে তো কোনো-কিছুর শেষ বলা যায় না। লাভই শেষ। শক্তিকে শুদ্ধমাত্র খাটাইয়া চলাই তো শক্তির পরিণাম নহে, সিদ্ধিতে পৌঁছানোই পরিণাম । আগুনে কেবল ইন্ধন চাপানেই তো লক্ষ্য নহে, রন্ধনেই তাহার সার্থকতা। কিন্তু যুরোপ মানুষকে এমন-কোনো জায়গায় লক্ষ্যস্থাপন করিতে দেয় নাই, কাজ যেখানে তাহার স্বাভাবিক পরিণামে আসিয়া হাফ ছাড়িয়া বীচিতে পারে। টাকা সংগ্ৰহ করিতে চাও, সংগ্রহের তো শেষ নাই ; জগতের খবর জানিতে চাও, জানার তো অন্ত নাই ; সভ্যতাকে progress বলিয়া থাক, প্রোগ্রেস শব্দের অর্থই এই দাড়াইয়াছে যে, কেবলই পথে চলা কোথাও ঘরে না পৌঁছানো । এইজন্য জীবনকে না-শেষের মধ্যে হঠাৎ শেষ করা, না-থামার মধ্যে হঠাৎ থামিয়া যাওয়া যুরোপের জীবনযাত্রা । Not the game but the chase— fikk পাওয়া নহে, শিকারের পশ্চাতে অনুধাবন করাই য়ুরোপের কাছে আনন্দের সারভাগ বলিয়া গণ্য হয় । যাহা হাতে পাওয়া যায়, তাহাতে সুখ নাই, এ কথা কি আমরাও বলি না ? আমরাও বলি নিঃস্বে ব্যষ্টি শতং। শতী দশশতাং লক্ষং সহস্ৰাধিপো । লক্ষেশঃ ক্ষিতিপালতাং ক্ষিতিপতিশচক্ৰেশ্বরত্বং পুনঃ ॥ চক্রেশঃ পুনরিন্দ্ৰতাং সুরপতিব্ৰাহ্মং পদং বাঞ্ছতি | ব্ৰহ্মা বিষ্ণুপদং হরিঃ শিবপদং ত্বশাবধিং কো গতঃ ॥ এক কথায়, যে যাহা পায়, তাহাতে তাহার আশা মিটে না— যতই বেশি পাও-না কেন, তাহার চেয়ে বেশি পাইবার দিকে মন ছুটে । তবে আর কাজের অন্ত হইবে কেমন করিয়া ? পাওয়াতে যখন চাওয়ার শেষ নহে, তখন অসম্পূৰ্ণ আশার মধ্যে অসমাপ্ত কর্ম লইয়া মরাই মানুষের একমাত্র গতি বলিয়া মনে হয় । এইখানে ভারতবর্ষ বলিয়াছেন, আর-সমস্ত পাওয়ার এই লক্ষণ বটে, কিন্তু এক জায়গায় পাওয়ার সমাপ্তি আছে। সেইখানেই যদি লক্ষ্যস্থাপন করি, তবে কাজের অবসান হইবে, আমরা ছুটি পাইব । কোনোখানেই চাওয়ার শেষ নাই, জগৎটা এতবড়ো একটা ফাকি, জীবনটা এতবড়ো একটা পাগলামি হইতেই পারে না। মানুষের জীবনসংগীতে কেবলই অবিশ্রাম তানই আছে, আর কোনাে জায়গাতেই সম নাই, এ কথা আমরা মানি না । অবশ্য এ কথা বলিতে হইবে, তান যতই মনোহর হউক, তাহার মধ্যে গানের অকস্মাৎ শেষ হইলে রসবোধে আঘাত লাগে, সমে আসিয়া শেষ হইলে সমস্ত তানের লীলা নিবিড় আনন্দের মধ্যে পরিসমাপ্ত হয় । , ভারতবর্ষ তাই কাজের মাঝখানে জীবনকে মৃত্যু দ্বারা হঠাৎ বিচ্ছিন্ন হইতে উপদেশ দেন নাই। পুরাদমের মধ্যেই সঁাকে ভাঙিয়া হঠাৎ অতলে তলাইয়া যাইতে বলেন নাই, তাহাকে ইস্টশনে আনিয়া পীেছাইয়া দিতে চাহিয়াছেন। সংসার কোনোদিন সমাপ্ত হইবে না, এ কথা ঠিক ; জীবসৃষ্টির আরম্ভ ইহঁতে আজ পর্যন্ত উন্নতি-অবনতির ঢেউখেলার মধ্য দিয়া সংসার চলিয়া আসিতেছে, তাহার বিরাম নাই। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের সংসারলীলার যখন শেষ আছে, তখন মানুষ যদি একটা সম্পূর্ণতার উপলব্ধিকে না জানিয়া প্ৰস্থান করে, তবে তাহার কী হইল ? বাহিরে কিছুর শেষ নাই, কেবলই একটা হইতে আর-একটা বাড়িয়াই চলিয়াছে। এই চির-চলমান বহিঃসংসারের দােলায় দুলিয়া আমরা মানুষ হইয়াছি— আমার পক্ষে একদিন সে-দোলার কাজ ফুরাইলেও কোনোদিন একবারে তাহার কাজ শেষ হইবে না। এই কথা মনে করিয়া, আমার যতটুকু সাধ্য, এই প্রবাহের পথকে আগে ঠেলিয়া দিতে হইবে । ইহার জ্ঞানের ভাণ্ডারে আমার সাধ্যমত জ্ঞান, ইহার কর্মের চক্রে আমার সাধ্যমত বেগ সঞ্চার করিয়া দিতে হইবে। কিন্তু তাই বলিয়া বাহিরের এই