পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ > じ রবীন্দ্র-রচনাবলী অক্ষৌহিণী সেনার দম্ভ, উদ্যতমাস্তুল বৃহদাকার যুদ্ধজাহাজের ঔদ্ধত্য আমাদের চিত্তকে আর অভিভূত করে না ; আমাদের মর্মস্থলে ভারতবর্ষের বহুযুগের একটি সজলজলদগন্তীর ওংকারধ্বনি নিত্যজীবনের আদিসুরটিকে জগতের সমস্ত কোলাহলের উর্ধের্ব জাগাইয়া তুলে । ইহাকে আমরা কোনােমতেই অস্বীকার করিতে পারিব না; যদি করি, তবে ইহার পরিবর্তে আমরা এমন কিছুই পাইব না, যাহার দ্বারা আমরা মাথা তুলিয়া দাড়াইব, যাহার দ্বারা আমরা আপনাকে রক্ষা করিতে পারিব। আমরা কেবলই তরবারির ছটা, বাণিজ্যের ঘাটা, কলকারখানার রক্তচক্ষু এবং স্বর্গের প্রতিস্পধী যে ঐশ্বর্য উত্তরোত্তর আপনার উপকরণস্তুপকে উচ্চে তুলিয়া আকাশের সীমা মাপিবার ভান করিতেছে তাহার উৎকটমূর্তি দেখিয়া সমস্ত মনেপ্ৰাণে কেবলই পরাস্ত পরাভূত হইতে থাকিব, কেবলই সংকুচিত শঙ্কিত হইয়া পৃথিবীর রাজপথে ভিক্ষাসম্বল দীনহীনের মতো ফিরিয়া বেড়াইব । অথচ এ কথাও আমি কোনোমতেই স্বীকার করি না যে, আমরা যাহাকে শ্রেয় বলিতেছি, তাহা কেবল আমাদের পক্ষেই শ্রেয় ! আমরা অক্ষম বলিয়া ধর্মকে দায়ে পড়িয়া বরণ করিতে হইবে, তাহাকে দারিদ্র্য গোপন করিবার একটা কৌশলস্বরূপে গ্ৰহণ করিতে হইবে, এ কথা কখনোই সত্য · নহে । প্রাচীন সংহিতাকার মানবজীবনের যে আদর্শ আমাদের সম্মুখে ধরিয়াছেন, তাহা কেবলমাত্র কোনো একটি বিশেষ জাতির বিশেয অবস্থার পক্ষেই সত্য, তাহা নহে। ইহাই একমাত্র সত্য আদর্শ সুতরাং ইহাই সকল মানুষেরই পক্ষে মঙ্গলের হেতু | প্রথম বয়সে শ্রদ্ধার দ্বারা সংযমের দ্বারা ব্ৰহ্মচর্যের দ্বারা প্রস্তুত হইয়া দ্বিতীয় বয়সে সংসার-আশ্রমে মঙ্গলকাৰ্মে আত্মাকে পরিপুষ্ট করিতে হইবে ; তৃতীয় বয়সে উদারতর ক্ষেত্রে একে একে সমস্ত বন্ধন শিথিল করিয়া অবশেষে আনন্দের সহিত মৃত্যুকে মোক্ষের নামান্তররূপে গ্রহণ করিবে- মানুষের জীবনকে এমন করিয়া চালাইলেই তবে তাহার আদ্যন্তসংগত পূর্ণ তাৎপর্য পাওয়া যায়। তবেই সমুদ্র হইতে যে মেঘ উৎপন্ন হইয়া পর্বতের রহস্যগঢ় গুহা হইতে নদীরূপে বাহির হইল, সমস্ত যাত্রাশেষে আবার তাহাকে সেই সমুদ্রের মধ্যেই পূর্ণতররূপে সম্মিলিত হইতে দেখিয়া তৃপ্তিলাভ করি | মাঝপথে যেখানেই হউক, তাহার অকস্মাৎ অবসান ংগত অসমাপ্ত। এ কথা যদি অন্তরের সঙ্গে বুঝিতে পারি, তবে বলিতেই হইবে, এই সত্যকেই উপলব্ধি করিবার জন্য সকল জাতিকেই নানা পথ দিয়া নানা আঘাতে ঠেকিয়া বারংবার চেষ্টা করিতেই হইবে । ইহার কাছে বিলাসীর উপকরণ, নেশনের প্রতাপ, রাজার ঐশ্বৰ্য, বণিকের সমৃদ্ধি, সমস্তই গৌণ ; মানুষের আত্মাকে জয়ী হইতে হইবে, মানুষের আত্মাকে মুক্ত হইতে হইবে, তবেই মানুষের এতকালের সমস্ত চেষ্টা সার্থক হইবে—- নহিলে ততঃ কিম, ততঃ কিম, ততঃ কিম ? 〉○>○ আনন্দরাপ সত্যং জ্ঞানমনন্তম । তিনি সত্য, তিনি জ্ঞান, তিনি অনন্ত । এই অনন্ত সত্যে, অনন্ত জ্ঞানে তিনি আপনাতে আপনি বিরাজিত | সেখানে আমরা তাহাকে কোথায় পাইব ? সেখান হইতে যে বাক্যমন নিবৃত্ত হইয়া আসে । কিন্তু উপনিষদ এ কথাও বলেন যে, এই সত্যং জ্ঞানমনন্তম আমাদের কাছে প্রকাশ পাইতেছেন। তিনি অগোচর নহেন । কিন্তু তিনি কই প্রকাশ পাইতেছেন ? কোথায় ? আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । তাহার আনন্দরূপ অমৃতরূপ আমাদের কাছে প্রকাশ পাইতেছে। তিনি যে আনন্দিত, তিনি যে রসস্বরূপ, ইহাই আমাদের নিকট প্রকাশমান । তেব কোথায় প্রকাশমান ? এ প্রশ্ন কি জিজ্ঞাসা করিতে হইবে ? যাহা অপ্রকাশিত, তাহার সম্বন্ধেই প্রশ্ন চলিতে পারে, কিন্তু যাহা প্রকাশিত, তাহাকে “কোথায়” বলিয়া কে সন্ধান করিয়া বেড়ায় ? প্রকাশ কোনখানে ? এই যে চারিদিকে যাহা দেখিতেছি, তাহাই যে প্রকাশ। এই যে সম্মুখে, এই