পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

|ান্তিনি.েČბ\5თ ○ ○○ আমরা আর কোনাে চরম কথা জানি বা না জানি, নিজের ভিতর থেকে একটি চরম কথা বুঝে নিয়েছি, সেটি হচ্ছে এই যে, একমাত্র প্রেমের মধ্যেই সমস্ত দ্বন্দ্ব এক সঙ্গে মিলে থাকতে পারে। যুক্তিতে তারা কাটাকাটি করে, কর্মেতে তারা মারামারি করে, কিছুতেই তারা মিলতে চায় না, প্রেমেতে সমস্তই মিটমাট হয়ে যায়। তর্কক্ষেত্রে কর্মক্ষেত্রে যারা দিতিপুত্র ও অদিতিপূত্রের মতো পরস্পরকে একেবারে বিনাশ করবার জন্যেই সর্বদা উদ্যত, প্রেমের মধ্যে তারা আপন ভাই। তর্কের ক্ষেত্রে দ্বৈত এবং অদ্বৈত পরস্পরের একান্ত বিরোধী ; ই যেমন না-কে কাটে, না যেমন হাঁ-কে কাটে, তারা তেমনি বিরোধী। কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে দ্বৈত এবং অদ্বৈত ঠিক একই স্থান জুড়ে রয়েছে। প্রেমেতে একই কালে দুই হওয়াও চাই, এক হওয়াও চাই। এই দুই প্ৰকাণ্ড বিরোধের কোনোটাই বাদ দিলে চলে না— আবার তাদের বিরুদ্ধরূপে থাকলেও চলবে না । যা বিরুদ্ধ তাকে অবিরুদ্ধ হয়ে থাকতে হবে এই এক সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড এ কেবল প্রেমেতেই ঘটে | এইজনাই, কেন যে আমি অন্যের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে যাই, নিজের ভিতরকার এই রহস্য তলিয়ে বুঝতে পারি নে— কিন্তু স্বাৰ্থ জিনিসটা বোঝা কিছুই শক্ত নয়। ভগবান প্রেমস্বরূপ কিনা তাই তিনি এককে নিয়ে দুই করেছেন আবার দুইকে নিয়ে এক করেছেন । স্পষ্টই যে দেখতে পাচ্ছি, দুই যেমন সত্য, একও তেমনি সত্য। এই অদ্ভুত ব্যাপারটাকেও তো যুক্তির দ্বারা নাগাল পাওয়া যাবে না, এ যে প্রেমের কাণ্ড । উপনিষদে ঈশ্বরের সম্বন্ধে এইজন্যে কেবলই বিরুদ্ধ কথাই দেখতে পাই। য একোহবৰ্ণো বহুধাশক্তিযোগাৎ বর্ণাননেকান্নিহিতার্থে দধাতি । তিনি এক, এবং তার কোনো বর্ণ নেই। অথচ বহুশক্তি নিয়ে সেই জাতিহীন এক, অনেক জাতির গভীর প্রয়োজনসকল বিধান করেছেন । যিনি এক, তিনি আবার কোথা থেকে অনেকের প্রয়োজনসকল বিধান করতে যান। তিনি যে প্রেমস্বরূপ- তাই, শুধু এক হয়ে তার চলে না, অনেকের বিধান নিয়েই তিনি থাকেন । স পর্ষগৎ শুক্ৰং আবার তিনিই ব্যদধাৎ শাশ্বতীভাঃ সমাভ্যঃ- অর্থাৎ, অনন্ত দেশে তিনি স্তব্ধ হয়ে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, আবার অনন্তকালে তিনি বিধান করছেন, তিনি কাজ করছেন। একাধারে স্থিতিও डिनि, १डि७ ऊिनि । আমাদের প্রকৃতির মধ্যেও এই স্থিতি ও গতির সামঞ্জস্য আমরা একটি মাত্র জায়গায় দেখতে পাই ; সে হচ্ছে প্ৰেমে । এই চঞ্চল সংসারের মধ্যে যেখানে আমাদের প্ৰেম, কেবলমাত্র সেইখানেই আমাদের চিত্তের স্থিতি— আর সমস্তকে আমরা ছুই আর চলে যাই, ধরি আর ছেড়ে দিই, যেখানে প্রেম সেইখানেই আমাদের মন স্থির হয় । অথচ সেইখানেই তার ক্রিয়াও বেশি । সেইখানেই আমাদের মন সকলের চেয়ে সচল । প্রেমেতেই যেখানে স্থির করায় সেইখানেই অস্থির করে । প্রেমের মধ্যেই স্থিতি গতি এক নাম নিয়ে আছে । কর্মক্ষেত্রে ত্যাগ এবং লাভ ভিন্নশ্রেণীভুক্ত— তারা বিপরীত পর্যায়ের । প্রেমেতে ত্যাগও যা লাভও তাই । যাকে ভালোবাসি তাকে যা দিই। সেই দেওয়াটাই লাভ । আনন্দের হিসাবের খাতায় জমা খরচ একই জায়গায়— সেখানে দেওয়াও যা পাওয়াও তাই । ভগবানও সৃষ্টিতে এই যে আনন্দের যজ্ঞ, এই যে প্রেমের খেলা ফেদেছেন, এতে তিনি নিজেকে দিয়ে নিজেকেই লাভ করছেন । এই দেওয়া-পাওয়াকে একেবারে এক করে দেওয়াকেই বলে প্ৰেম | দর্শনশাস্ত্রে মস্ত একটা তর্ক আছে, ঈশ্বর পুরুষ কি অপুরুষ, তিনি সগুণ কি নিৰ্গুণ, তিনি personal কি impersonal ? প্রেমের মধ্যে এই হাঁ না একসঙ্গে মিলে আছে। প্রেমের একটা কোটি সগুণ, আর একটা কোটি নিৰ্গুণ । তার এক দিক বলে, আমি আছি, আর এক দিক বলে, আমি নেই। “আমি” না হলেও প্ৰেম নেই, “আমি” না ছাড়লেও প্ৰেম নেই। সেইজন্যে ভগবান সগুণ কি নিৰ্গুণ, সে সমস্ত তর্কের কথা কেবল তর্কের ক্ষেত্রেই চলে— সে তর্ক তাকে স্পর্শও করতে পারে না ।