পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○8○ রবীন্দ্র-রচনাবলী নিত্যতা সম্বন্ধেও তীর কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না, এ কথা নিশ্চিত | তবে তিনি কী ভাবে অমৃত হতে চেয়েছিলেন । তিনি এই কথা বলেছিলেন, সংসারে আমরা তো কেবলই একটার ভিতর দিয়ে আর একটাতে চলেছি— কিছুতেই তো স্থির হয়ে থাকতে পারছি নে ! আমার মনের বিষয়গুলোও সরে যায়, আমার মনও সরে যায়। যাকে আমার চিত্ত অবলম্বন করে তাকে যখন ছাড়ি তখন তার সম্বন্ধে আমার মৃত্যু ঘটে । এমনি করে ক্রমাগত এক মৃত্যুর ভিতর দিয়ে আর মৃত্যুতে চলেছি— এই যে মৃত্যুর পর্যায় এর আর অন্ত নেই | অথচ আমার মন এমন কিছুকে চায় যার থেকে তাকে আর নড়তে হবে না— যেটা পেলে সে বলতে পারে, এ ছাড়া আমি আর বেশি চাই নে— যাকে পেলে আর ছাড়া-ছাড়ির কোনো কথাই উঠবে। না । তা হলেই তো মৃত্যুর হাত একেবারে এড়ানো যায়। এমন কোন মানুষ এমন কোন উপকরণ আছে যাকে নিয়ে বলতে পারি, এই আমার চিরজীবনের সম্বল লাভ হয়ে গেল— আর কিছুই দরকার নেই । এ-সব নিয়ে আমি কী করব । আমি যে অমৃতকে চাই । আচ্ছা, বেশ, উপকরণ তো অমৃত নয়, তা হলে অমৃত কী ! আমরা জানি, অমৃত কী। পৃথিবীতে একেবারে যে তার স্বাদ পাই নি, তা নয়। যদি না পেতুম তা হলে তার জন্যে আমাদের কান্না উঠত না | আমরা সংসারের সমস্ত বিষয়ের মধ্যে কেবলই তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, তার কারণ, ক্ষণে-ক্ষণে সে আমাদের সম্পর্শ করে যায় । মৃত্যুর মধ্যে এই অমৃতের স্পর্শ আমরা কোনখানে পাই ? যেখানে আমাদের প্ৰেম আছে । এই প্রেমেই আমরা অনন্তের স্বাদ পাই ] প্রেমই সীমার মধ্যে অসীমতার ছায়া ফেলে পুরাতনকে নবীন করে রাখে, মৃত্যুকে কিছুতেই স্বীকার করে না | সংসারের বিচিত্র বিষয়ের মধ্যে এই যে প্রেমের আভাস, দেখতে পেয়ে আমরা মৃত্যুর অতীত পরম পদার্থের পরিচয় পাই, তার স্বরূপ যে প্রেমস্বরূপ তা বুঝতে পারি- এই প্রেমকেই যখন পরিপূর্ণরূপে পাবার জন্যে আমাদের অন্তরাত্মার সত্য আকাঙক্ষণ আবিষ্কার কিমহং তেন। কুৰ্যাম।” এই যে বলা, এটি যখন রমণীর মুখের থেকে উঠেছে তখন কী স্পষ্ট, কী সতী, কী মধুর হয়েই উঠেছে। সমস্ত চিন্তা সমস্ত যুক্তি পরিহার করে কী অনায়াসেই এটি ধ্বনিত হয়ে উঠছে ! ওগো, আমি ঘর-দুয়ার কিছুই চাই নে ? আমি প্রেম চাই— এ কী কান্না | মৈত্রেয়ীর সেই সরল কান্নাটি যে প্রার্থনারূপ ধারণ করে জাগ্রত হয়ে উঠেছিল তেমন আশ্চর্য পরিপূর্ণ প্রার্থনা কি জগতে আর কোথাও কখনো শোনা গিয়েছে ? সমস্ত মানবহৃদয়ের একান্ত প্রার্থনাটি এই রমণীর ব্যাকুলকণ্ঠে চিরন্তনকালের জন্যে বাণীলাভ করেছে। এই প্রার্থনাই আমাদের প্রত্যেকের একমাত্র প্রার্থনা, এবং এই প্রার্থনাই বিশ্বমানবের বিরাট ইতিহাসে যুগে যুগান্তরে উচ্চারিত হয়ে আসছে । t যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুর্যম— এই কথাটি সবেগে বলেই কি সেই ব্ৰহ্মবাদিনী তখনই জোড়হাতে উঠে দাড়ালেন এবং তঁর অশ্রুগ্নাবিত মুখটি আকাশের দিকে তুলে বলে উঠলেনআসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতিৰ্গময়, মৃতোর্মামৃতং গময়— আবিরাবীর্ম ঐধি— রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং তেন মাং পাহি নিত্যম ? f উপনিষদে পুরুষের কণ্ঠে আমরা অনেক গভীর উপলব্ধির কথা পেয়েছি, কিন্তু কেবল স্ত্রীর কঠেই এই একটি গভীর প্রার্থনা লাভ করেছি। আমরা যথার্থ কী চাই অথচ কী নেই, তার একাগ্র অনুভূতি প্রেমকাতর রমণীহৃদয় থেকেই অতি সহজে প্রকাশ পেয়েছে। হে সত্য, সমস্ত অসত্য হতে আমাকে তোমার মধ্যে নিয়ে যাও, নইলে যে আমাদের প্ৰেম উপবাসী হয়ে থাকে ; হে জ্যোতি, গভীর অন্ধকার