পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(?"br রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু সংসার জিনিসটা যে কেবলই সরে, কেবলই সরায় । এখানে হয় সরতে থাকো, নয় মরতে থাকে । এখানে যে বলেছে ‘আমার যথেষ্ট হয়েছে- এইবার যথেষ্টের মধ্যে বাসা বান্ধব', সেই ডুবেছে । ইতিহাসে বড়ো বড়ো জাতির মধ্যেও দেখতে পাই যে, তারা এক জায়গায় এসে বলে “এইবার আমার পূর্ণতা হয়েছে— এইবার আমি সঞ্চয় করব, রক্ষা করব, বাধািৰ্বাধি হিসােব বরাদ্দ করব, এইবার আমি ভোগ করব?" - তখন আর সে নৃত্যুন তত্ত্বকে বিশ্বাস করে না- তখন তার এতদিনের পথের সম্বল ধর্মনীতিকে দুর্বলতা বলে উপহাস ও অপমান করতে থাকে, মনে করে এখন আর এর প্রয়োজন নেই- 'এখন আমি বলী, আমি জয়ী, আমি প্রতিষ্ঠিত | কিন্তু প্রবাহের উপরে যে লোক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপন করতে চায় তার যে দশা হয় সে কারও অগোচর নেই । তাকে ডুবিতেই হয়। এমন কত জাতি ডুবে গেছে । কেবলই উন্নতি, কেবলই গতি, পরিণাম কোথাও নেই, এমন একটা অদ্ভুত কথার উৎপত্তি হয়েছে। এই কারণেই । কারণ, মানুষ দেখেছে সংসারে থামতে গেলেই মরতে হয় । এই নিয়মকে যারা উপলব্ধি করেছে তারা স্থিতি ও লাভকে অস্বীকার করে । স্থিতিহীন গতি, লাভহীন চেষ্টাই যদি মানুষের ভাগ্য হয় তবে এমন ভয়ানক দূৰ্ভাগ্য। আর কী হতে পারে । এ কথা ঐশ্বর্যগর্বের উন্মত্ততায় অন্ধ হয়ে বলা চলে কিন্তু এ কথা আমাদের অন্তরাত্মা কখনোই সম্পূর্ণ সম্মতির সঙ্গে বলতে পারে না । তার কারণ, একটা জায়গায় আমাদের পাওয়ার পন্থা আছে | সে হচ্ছে যেখানে ঈশ্বর স্বয়ং নিজেকে ধরা দিয়েছেন । সেখানে আমরা তাকে পাই কেন, না। তিনি নিজেকে দিতে চান বলেই পাই ; কোথায় পাই ? বাহিরে নয়, প্রকৃতিতে নয়, বিজ্ঞানতত্ত্বে নয়, শক্তিতে নয়— পাই জীবাত্মায় । কারণ, সেখানে তীরে আনন্দ, তার প্ৰেম । সেখানে তিনি নিজেকে দিতেই চান | যদি কোনো বাধা থাকে তো সে আমাদেরই দিকে -- তার দিকে নয় । এই প্রেমে পাওয়ার মধ্যে তামসিকতা নেই, জড়ত্ব নেই ; এই যে লাভ এ চরম লাভ বটে, কিন্তু পঞ্চতুলাভের মতো এতে আমরা বিনষ্ট হই নে । তার কারণ, আমরা পর্বেই একদিন আলোচনা করেছি । শক্তির পাওয়া ব্যাপারে পেলেই শক্তি নিশ্চেষ্ট হয়, কিন্তু প্রেমের পাওয়ায় পেলে প্রেম নিশ্চেষ্ট হয় না- বরঞ্চ তার চেষ্টা আরো গভীররূপে জাগ্রত হয় । এইজন্যে এই যে প্রেমের ক্ষেত্রে ঈশ্বর আমাদের কাছে ধরা দেন– এই ধরা দেওয়ার দরুন তিনি আমাদের কাছে ছোটাে হয়ে যান না- তার পাওয়ার আনন্দ নিরন্তর প্রবাহিত হয়— সেই পাওয়া নিত্য নূতন থাকে । মানুষের মধ্যেও যখন আমাদের সত্য প্ৰেম জাগ্রত হয়ে ওঠে তখন সেই প্রেমের বিষয়কে লাভ করেও লাভের অন্ত থাকে না- এমন স্থলে ব্রহ্মের কথা কী বলব ? সেই কথা উপনিষৎ বলেছেন— আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বান ন বিভেতি কদাচন | ব্ৰহ্মের আনন্দ ব্ৰহ্মের প্ৰেম খিনি জেনেছেন তিনি কোনোকালেই আর ভয় পান না । অতএব মানুষের একটা এমন পাওয়া আছে যার সম্বন্ধে চিরকালের কথাটা প্রয়োগ করা যেতে পারে | ভারতবর্ষ এই পাওয়ার দিকেই খুব করে মন দিয়েছিলেন । সেইজন্যেই ভারতবর্ষের হৃদয় মৈত্রেয়ীর মুখ দিয়ে বলেছেন— যেনাহং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুর্যাম ? সেইজন্যে মৃত্যুর দিক থেকে অমৃতের দিকে ভারতবর্ষ আপনার আকাঙক্ষা প্রেরণ করেছিলেন । সে দিকে যারা মন দিয়েছে বাইরে থেকে দেখে তাদের বড়ো বলে তো বোধ হয় না । তাদের উপকরণ কোথায় ? ঐশ্বৰ্য কোথায় % শক্তির ক্ষেত্রে যারা সফল হয় তারা আপনাকে বড়ো করে সফল হয়— আর অধ্যাত্মক্ষেত্রে যারা