পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qbrの রবীন্দ্র-রচনাবলী পূর্ব এবং পশ্চিম দিক যেমন একটি অখণ্ড গোলকের মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে— প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক তেমনি একটি অখণ্ডতার দ্বারা বিধৃত । এর মধ্যে একটিকে পরিহার করতে গেলেই আমরা সমগ্রতার কাছে অপরাধী হব— এবং সে অপরাধের দণ্ড অবশ্যম্ভাবী। ভারতবর্ষ যে পরিমাণে আধ্যাত্মিকতার দিকে অতিরিক্ত ঝোক দিয়ে প্রকৃতির দিকে ওজন হারিয়েছে, সেই পরিমাণে তাকে আজ পর্যন্ত জরিমানার টাকা গুনে দিয়ে আসতে হচ্ছে। এমন-কি, তার যথাসর্বস্ব বিকিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ভারতবর্ষ যে আজ শ্ৰীভ্রষ্ট হয়েছে তার কারণ এই যে, সে একচক্ষু হরিণের মতো জানত না যে, যে দিকে তার দৃষ্টি থাকবে না সেই দিক থেকেই ব্যাধের মৃত্যুবাণ, এসে তাকে আঘাত করবে। প্রাকৃতিক দিকে সে নিশ্চিন্তভাবে কানা ছিল— প্রকৃতি তাকে মৃত্যুবাণ মেরেছে। এ কথা যদি সত্য হয় যে পাশ্চাত্য জাতি প্ৰাকৃতিক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ জয়লাভ করবার জন্যে একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে, তা হলে এ কথা নিশ্চয় জানতে হবে একদিন তার পরাজয়ের ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ অন্য দিক থেকে এসে তার মর্মস্থানে বাজবে । মূলে যাদের ঐক্য আছে, সেই ঐক্যমূল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলে তারা যে কেবল পৃথক হয় তা নয়, তারা পরস্পরের বিরোধী হয় । ঐক্যের সহজ টানে যারা আত্মীয়রূপে থাকে, বিচ্ছিন্নতার ভিতর দিয়ে তারা প্ৰলয়সংঘাতে আকৃষ্ট হয় । অর্জন এবং কর্ণ সহােদর ভাই । মাঝখানে কুন্তীর বন্ধন তারা যদি না হারিয়ে ফেলত তা হলে পরস্পরের যোগে তারা প্রবল বলী হত ; সেই মূল বন্ধনটি বিস্মৃত হওয়াতেই তারা কেবলই বলেছে, “হয় আমি মরব নয় তুমি মরবে ।” তেমনি আমাদের সাধনাকে যদি অত্যন্ত ভাবে প্রকৃতি অথবা আত্মার দিকে স্থাপন করি, তা হলে আমাদের ভিতরকার প্রকৃতি এবং আত্মার মধ্যে লড়াই বেধে যায়। তখন প্রকৃতি বলে “আত্মা মরুক আমি থাকি, আত্মা বলে ‘প্রকৃতিটা নিঃশেষে মরুক আমি একাধিপত্য করি । তখন প্রকৃতির দলের লোকেরা কর্মকেই প্রচণ্ড এবং উপকরণকেই প্ৰকাণ্ড করে তুলতে চেষ্টা করে ; এর মধ্যে তুমার দয়ামায়া নেই, বিরাম বিশ্রাম নেই। ও দিকে আত্মার দলের লোকেরা প্রকৃতির রসদ একেবারে বন্ধ করে বসে, কর্মের পাট একেবারে তুলে দেয়, নানাপ্রকার উৎকট কৌশলের দ্বারা প্রকৃতিকে একেবারে নিমূল করতে চেষ্টা করে— জানে না সেই একই মূলের উপরে তার আত্মার কল্যাণও অবস্থিত । এইরূপে যে দুইটি পরস্পরের পরমাত্মীয়, পরম সহায়, মানুষ তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ স্থাপন করে তাদের পরম শত্রু করে তোলে। এমন নিদারুণ শক্ৰতা আর নেই- কারণ, এই দুই পক্ষই পরম ক্ষমতাশালী । 将 অতএব, প্রকৃতি এবং আত্মা, মানুষের এই দুই দিককে আমরা যখন স্বতন্ত্র করে দেখেছি তখন যত শীঘ্র সম্ভব এদের দুটিকে পরিপূর্ণ অখণ্ডতার মধ্যে সম্মিলিত রূপে দেখা আবশ্যক । আমরা যেন এই দুটি অনন্তবন্ধুর বন্ধুত্ব-সূত্রে অন্যায় টান দিতে গিয়ে উভয়কে কুপিত করে না তুলি । ২৬ পেশীষ محمجھے কম আমাদের দেশের জ্ঞানীসম্প্রদায় কর্মকে বন্ধন বলে থাকেন । এই বন্ধন থেকে সম্পূৰ্ণ মুক্ত হয়ে নিস্ক্রিয় হওয়াকেই তারা মুক্তি বলেন । এইজন্য কর্মক্ষেত্র প্রকৃতিকে তঁরা ধ্বংস করে নিশ্চিন্ত হতে চান । এইজন্য ব্ৰহ্মকেও তারা নিক্রিয় বলেন এবং যা-কিছু জাগতিক ক্রিয়া, একে মায়া বলে একেবারে অস্বীকার করেন ।