পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন Qbr> কিন্তু উপনিষৎ বলেন যতো বা ইমানি ভূতানি জায়ন্তে, যেন জাতানি জীবন্তি, যৎ প্ৰয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি তদ্বিজিজ্ঞাসম্ব, তদব্ৰহ্ম । র্যার থেকে সমস্তই জন্মাচ্ছে, র্যার দ্বারা জীবন ধারণ করছে, যাতে প্ৰয়াণ ও প্রবেশ করছে, তাকে জানতে ইচ্ছা! করো, তিনিই ব্ৰহ্ম | অতএব উপনিষদের ব্ৰহ্মবাদী বলেন, ব্ৰহ্মই সমস্ত ক্রিয়ার আধার। তা যদি হয় তবে কি তিনি এই-সকল কর্মের দ্বারা বদ্ধ ? এক দিকে কর্ম। আপনিই হচ্ছে, আর-এক দিকে ব্ৰহ্ম স্বতন্ত্র হয়ে রয়েছেন, পরস্পরে কোনো যোগ নেই, এ কথাও যেমন আমরা বলতে পারি নে, তেমনি তার কর্ম মাকড়সার জালের মতো, শামুকের খোলার মতো, তার নিজেকে বদ্ধ করছে। এ কথাও বলা চলে না | এইজন্যই পরীক্ষণে ব্ৰহ্মবাদী বলছেন আনন্দাদ্ধোৰ খন্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতনি জীবন্তি আনন্দং প্রয়স্তাভিসংবিশন্তি । ব্ৰহ্ম আনন্দস্বরূপ । সেই আনন্দ হতেই সমস্ত উৎপন্ন, জীবিত, সচেষ্ট এবং রূপান্তরিত হচ্ছে । কর্ম দুই রকমে হয়— এক অভাবের থেকে হয়, আর প্রাচুর্য থেকে হয়। অর্থাৎ, প্রয়োজন থেকে হয় বা আনন্দ থেকে হয় । প্রয়োজন থেকে, অভাব থেকে, আমরা যে কর্ম করি সেই কমই আমাদের বন্ধন ; আনন্দ থেকে যা করি সে তো বন্ধন নয়, বস্তুত সেই কৰ্মই মুক্তি । এইজন্য আনন্দের স্বভাবই হচ্ছে ক্রিয়া— আনন্দ স্বতই নিজেকে বিচিত্র প্রকাশের মধ্যে মুক্তিদান করতে থাকে | সেইজন্যই অনন্ত আনন্দের অনন্ত প্ৰকাশ ৷ ব্ৰহ্ম যে আনন্দ সে এই অনিঃশেষ প্রকাশধর্মের দ্বারাই অহরহ প্ৰমাণ হচ্ছে । তার ক্রিয়ার মধ্যেই তিনি আনন্দ, এইজন্য তার কর্মের মধ্যেই তিনি মুক্তস্বরূপ । আমরাও দেখেছি আমাদের আনন্দের কর্মের মধ্যেই আমরা মুক্ত। আমরা প্ৰিয়বন্ধুর যে কাজ করি সে কাজ আমাদের দাসত্বে বদ্ধ করে না । শুধু বদ্ধ করে না তা নয়, সেই কৰ্মই আমাদের মুক্ত করে । কারণ, আনন্দের নিস্ক্রিয়তাই তার বন্ধন, কর্মই তার মুক্তি । তবে কর্ম কখন বন্ধন ? যখন তার মূল আনন্দ থেকে সে বিচ্যুত হয় । বন্ধুর বন্ধুত্বটুকু যদি আমাদের অগোচর থাকে, যদি কেবল তার কাজমাত্রই আমাদের চোখে পড়ে, তবে সেই বিনা বেতনের প্ৰাণপণ কাজকে তার প্রতি একটা ভয়ংকর অত্যাচার বলে আমাদের কাছে প্ৰতিভাত হবে । কিন্তু বস্তুত তার প্রতি অত্যাচার কোনটা হবে ? যদি তার কাজ বন্ধ করে দিই। কারণ, কর্মের মুক্তি আনন্দের মধ্যে এবং আনন্দের মুক্তি কর্মে | সমস্ত কর্মের লক্ষ্য আনন্দের দিকে এবং আনন্দের লক্ষ্য এইজন্য উপনিষৎ আমাদের কর্ম নিযেধ করেন নি। ঈশোপনিষৎ বলেছেন, মানুষ কর্মে প্রবৃত্ত হবে না। এ কোনোমতেই হতে পারে না । এইজন্য তিনি পুনশ্চ বলেছেন যারা কেবল অবিদ্যায় অর্থাৎ সংসারের কর্মেরত তারা অন্ধকারে পড়ে, আর যারা বিদ্যায় অর্থাৎ কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞানে রত। তারা ততোধিক অন্ধকারে পড়ে । এই সমস্যার মীমাংসাস্বরূপ বলেছেন কর্ম এবং ব্ৰহ্মজ্ঞান উভয়েরই প্রয়োজন আছে । অবিদ্যয়া মৃত্যুং ভীরত্ব বিদ্যয়ামৃতমশ্বতে । কর্মের দ্বারা মৃত্যু উত্তীর্ণ হয়ে বিদ্যদ্বারা জীব অমৃত লাভ করে। ব্ৰহ্মহীন কর্ম অন্ধকার এবং কর্মহীন ব্ৰহ্ম ততোধিক শূন্যতা । কারণ, তাকে নাস্তিকতা বললেও হয় । যে আনন্দস্বরূপ ব্ৰহ্ম হতে সমস্ত কিছুই হচ্ছে সেই ব্ৰহ্মকে এইসমস্ত কিছু-বিবর্জিত করে দেখলে সমস্তকে ত্যাগ করা হয়, সেইসঙ্গে তঁাকেও ত্যাগ করা হয় ।