পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (S ( মৃত্যুর প্রকাশ আজ পিতৃদেবের মৃত্যুর বাৎসরিক । তিনি একদিন ৭ই পৌঁষে ধর্মদীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন । শান্তিনিকেতনের আশ্রমে সেই তার দীক্ষাদিনের বার্ষিক উৎসব আমরা সমাধা করে এসেছি । সেই ৭ই পৌঁষে তিনি যে-দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, ৬ই মাঘ মৃত্যুর দিনে সেই দীক্ষাকে সম্পূর্ণ করে তীর মহৎ জীবনের ব্ৰত উদযাপন করে গেছেন । শিখা থেকে শিখা জ্বালাতে হয় । তীর সেই পরিপূর্ণ জীবন থেকে আমাদের অগ্নি গ্রহণ করতে হবে । এইজন্য ৭ই পৌঁষে যদি তার দীক্ষা হয়, ৬ই মাঘ আমাদের দীক্ষার দিন । তার জীবনের সমাপ্তি আমাদের জীবনকে দীক্ষা দান করে- জীবনের দীক্ষা | জীবনের ব্ৰত অতি কঠিন ব্রত, এই ব্ৰত্যের ক্ষেত্র অতি বৃহৎ, এর মন্ত্র অতি দুর্লভ, এর কর্ম অতি বিচিত্র, এর ত্যাগ অতি দুঃসাধা । যিনি দীর্ঘজীবনের নানা সুখে দুঃখে, সম্পদে বিপদে, মানে অপমানে তার একটি মন্ত্র কোনোদিন বিস্মৃত হন নি, তার একটি লক্ষ্য হতে কোনোদিন বিচলিত হন নি, র্যার জীবনে এই প্রার্থনা সত্য হয়ে উঠেছিল— মাহং ব্ৰহ্ম নির্যাকুযাম, মা মা ব্ৰহ্ম নিরাকারোৎ, অনির্যাকরণমস্ত— আমাকে ব্ৰহ্ম ত্যাগ করেন নি, আমি যেন তাকে ত্যাগ না করি, যেন তাকে পরিত্যাগ না হয়- তারই কাছ থেকে আজ আমরা বিক্ষিপ্ত জীবনকে এক পরমলক্ষ্যে সার্থকতা দান করবার মন্ত্র গ্রহণ করব । । পরিপক্ক ফল যেমন বৃন্তচু্যত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করে— তেমনি মৃত্যুর দ্বারাই তিনি তার জীবনকে আমাদের দান করে গেছেন । মৃত্যুর ভিতর দিয়ে না পেলে এমন সম্পূৰ্ণ করে পাওয়া যায় না । জীবন নানা সীমার দ্বারা আপনাকে বেষ্টিত করে রক্ষা করে- সেই সীমা কিছু-না-কিছু বাধা রচনা করে । মৃত্যুর দ্বারাই সেই মহাপুরুষ তার জীবনকে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ করেছেন— তার সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেছে— এই জীবনকে নিয়ে আমাদের কোনো সাংসারিক প্রয়োজনের তুচ্ছতা নেই, কোনো লৌকিক ও সাময়িক সম্বন্ধের ক্ষুদ্রতা নেই । তার সঙ্গে কেবল একটি মাত্র সম্পূৰ্ণ যোগ হয়েছে, সে হচ্ছে অমৃতের যোগ । মৃত্যই এই অমৃতকে প্রকাশ করে । মৃত্যু আজ তার জীবনকে আমাদের প্রত্যেকের নিকটে এনে দিয়েছে, প্রত্যেকের অন্তরে এনে দিয়েছে। এখন আমরা যদি প্ৰস্তুত থাকি, যদি তাকে গ্ৰহণ করি, তবে তার জীবনের সঙ্গে আমাদের জীবনের রাসায়নিক সম্মিলনের কোনো ব্যাঘাত থাকে না । তার পার্থিব জীবনের উৎসর্গ আজ কিনা ব্ৰহ্মের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছে, সেইজন্যে তিনি আজ সম্পূর্ণরূপে আমাদের সকলের হয়েছেন। বনের ফুল পূজা-অবসানে প্রসাদীফুল হয়ে আজ বিশেষরূপেই সকলের সামগ্ৰী হয়েছেন। আজ সেই ফুলে । তার পূজার পুণ্য সম্পূর্ণ হয়েছে, আজ সেই ফুলে তার দেবতার আশীর্বাদ মূর্তিমান হয়েছে। সেই পবিত্র নির্মাল্যটি মাথায় করে নিয়ে আজ আমরা বাড়ি চলে যাব, এইজনা তার মৃত্যুদিনের উৎসব । বিশ্বপােবন মৃত্যু আজ স্বয়ং সেই মহৎজীবনকে আমাদের সম্মুখে উদঘাটন করে দাড়িয়েছেনআদ্যকার দিন আমাদের পক্ষে যেন বার্থ না হয় । একদিন কোন ৭ই পৌঁষে তিনি একলা অমৃতজীবনের দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, সেদিনকার সংবাদ খুব অল্প লোকেই জেনেছিল। ৬ই মাঘে মৃত্যু যখন যবনিকা উদঘাটন করে দাঁড়াল তখন কিছুই আর প্রচ্ছন্ন রইল না । তার একদিনের সেই একলার দীক্ষা আজ আমরা সকলে মিলে গ্রহণ করবার অধিকারী হয়েছি। সেই অধিকারকে আমরা সার্থক করে যাব । ৬ মাঘ । কলিকাতা