পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VVb& প্রাণ ও প্রেম পিতা নােহসি এই মন্ত্রটি আমরা জীবনের মধ্যে গ্ৰহণ করব। কার কাছ থেকে গ্রহণ করব। যিনি পিতা র্তার কাছ থেকেই গ্রহণ করব। তাকে বলব, তুমি যে পিতা সে তুমিই আমাকে বুঝিয়ে দাও । আমার জীবনের সমস্ত ইতিহাসের ভিতর দিয়ে সমস্ত সুখ-দুঃখের ভিতর দিয়ে বুঝিয়ে দাও। পিতার সঙ্গে আমাদের যে সম্বন্ধ সে তো কোনো তৈরি-করা সম্বন্ধ নয়। রাজার সঙ্গে প্রজার, প্রভুর সঙ্গে ভূত্যের একটা পরস্পর বােঝাপড়া আছে, সেই বােঝাপড়ার উপরেই তাদের সম্বন্ধ। কিন্তু পিতার সঙ্গে পুত্রের সম্বন্ধ বাহ্যিক নয়, সে একেবারে আদিতম সম্বন্ধ। সে সম্বন্ধ পুত্রের অস্তিত্বের মূলে । অতএব এই গভীর আত্মীয়সম্বন্ধ কোনো বাহ্য অনুষ্ঠান কোনো ক্রিয়াকলাপের দ্বারা রক্ষিত হয় না, কেবল ভক্তির দ্বারা এবং ভক্তিজনিত কর্মের দ্বারাই এই সম্বন্ধকে স্বীকার করতে হয় । পিতার সঙ্গে পুত্রের মূল সম্বন্ধটি কোথায় ? প্রাণের মধ্যে। পিতার প্রাণই সন্তানের প্রাণে সঞ্চারিত | কেনোপনিষৎ প্রশ্ন করেছেন- কেন প্ৰাণঃ প্রথমঃ প্রৈতিযুক্ত ? প্ৰাণ কাহার দ্বারা তার প্রথম প্রৈতি (energy) লাভ করেছে ? এই প্রশ্নের মধ্যেই উত্তরটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে, যিনি মহাপ্ৰাণ তীর দ্বারা । জগতে কোনো প্ৰাণই তো একটি সংকীর্ণ সীমার মধ্যে, নিজের মধ্যে, নিজে আবদ্ধ নয় । সমস্ত জগতের প্রাণের সঙ্গে তার যোগ | আমার এই শরীরের মধ্যে যে প্ৰাণের চেষ্টা চলছে সে তো কেবলমাত্র এই শরীরের নয় ; জগৎজোড়া আকর্ষণ বিকর্ষণ, জগৎজোড়া রাসায়নিক শক্তি, জল, বাতাস, আলোক ও উত্তাপ একে নিখিলপ্রাণের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছে। বিশ্বের প্রত্যেক অণুপরমাণুর মধ্যেও যে অবিশ্রাম চেষ্টা আছে আমার এই শরীরের চেষ্টাও সেই বিরাট প্রাণেরই একটি মাত্ৰা । সেইজন্যই উপনিষৎ বলেছেন— যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্বং প্রাণ এজাতি নিঃসূতম, বিশ্বে এই যা-কিছু চলছে সমস্তই প্রাণ হতে নিঃসৃত হয়ে প্রাণেই স্পন্দিত হচ্ছে। এই প্ৰাণের স্পন্দন দূরতম নক্ষত্রেও যেমন আমার হৃৎপিণ্ডেও তেমনি, ঠিক একই সুরে একই তালে। প্ৰাণ কেবল শরীরের নয় । মনেরও প্ৰাণ আছে। মনের মধ্যেও চেষ্টা আছে। মন চলছে, মন বাড়ছে, মনের ভাঙাগড়া পরিবর্তন হচ্ছে। এই স্পন্দিত তরঙ্গিত মন কখনােই কেবল আমার ক্ষুদ্র বেড়াটির মধ্যে আবদ্ধ নয়। ঐ নর্তমান প্ৰাণের সঙ্গেই হাতধরাধরি করে নিখিল বিশ্বে সে আন্দোলিত হচ্ছে, নইলে আমি তাকে কোনোমতেই পেতে পারতুম না। মনের দ্বারা আমি সমস্ত জগতের মনের সঙ্গেই যুক্ত। সেইজন্যেই সর্বত্র তার গতিবিধি। নইলে আমার এই একঘরে অন্ধ মন কেবল আমারই আমার মনপ্রাণ অবিচ্ছিন্নভাবে নিখিল বিশ্বের ভিতর দিয়ে সেই অনন্ত কারণের সঙ্গে যোগযুক্ত । প্রতিমুহূর্তেই সেইখান হতে আমি প্ৰাণ চৈতন্য ধীশক্তি লাভ করছি। এই কথাটিকে কেবল বিজ্ঞানে জানা নয়, এই কথাটিকে ভক্তিদ্বারা উপলব্ধি করতে পারলে তবে ঐ মন্ত্র সার্থক হবে ; ওঁ পিতা নোহসি । আমার প্রাণের মধ্যে বিশ্বপ্রাণ- মনের মধ্যে বিশ্বমন আছে বললে এত বড়ো কথাটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করা হয় না, একে বাইরেই বসিয়ে রাখা হয়। আমার প্রাণের মধ্যে পিতার প্রাণ, আমার মনের মধ্যে পিতার মন আছে, এই কথাটি নিজেকে ভালো করে বলতে হবে । পিতার দিক থেকে কেবল যে আমাদের দিকে প্ৰাণ প্রবাহিত হচ্ছে তা নয়। তার দিক থেকে আমাদের দিকে অবিশ্রাম প্রেম সঞ্চারিত হচ্ছে। আমাদের মধ্যে কেবল যে একটা চেষ্টা আছে, গতি । আছে তা নয়, একটা আনন্দ আছে। আমরা কেবল বেঁচে আছি, কাজ করছি নয়, আমরা রস পাচ্ছি। আমাদের দেখায় শোনায় আহারে বিহারে কাজে কর্মে, মানুষের সঙ্গে নানাপ্রকার যোগে, নানা সুখNo (2 এই রসটি কোথা থেকে পাচ্ছি ? এইটিই কি আমাদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন ? এটা কেবল আমার এই একটি ছােটাে কারখানাঘরের সুরঙ্গের মধ্যে অন্ধকারে তৈরি হচ্ছে ? ?