পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VAS) দশের ইচ্ছা! আমার সমস্ত জীবন একদিন তাকে পিতা নোহসি বলতে পারবে, আমি তীরই পুত্র এই কথাটা একদিন সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, এই আকাঙক্ষাটিকে উজ্জ্বল করে ধরে রাখা বড়ো কঠিন । অথচ আমাদের মনে কত অত্যাকাঙক্ষা আছে, কত অসাধ্যসাধনের সংকল্প আছে, কিছুতেই সেগুলি নিরন্ত হতে চায় না। বাইরে থেকে যদি বা খাদ্য জোগাতে নাও পারি, তবু বুকের রক্ত দিয়ে তাকে পোষণ করি । অথচ যে-আকাঙক্ষ সকলের চেয়ে বড়ো, যা সকলের চেয়ে চরমের দিকে যায়, তাকে প্রতিদিন জাগ্রত করে রাখা এত শক্ত কেন ? তার কারণ আছে। আমরা মনে করি আকাঙক্ষ জিনিসটা আমার নিজেরই মনের সামগ্ৰী— আমিই ইচ্ছা করছি এবং সে ইচ্ছার আরম্ভ আমারই মধ্যে । বস্তুত তা নয়। আমার মধ্যে আমার চতুর্দিক ইচ্ছা করে । আমার জারক রস আমার জঠরেরই উৎপন্ন সামগ্ৰী বটে, কিন্তু আমার ইচ্ছা কেবল আমারই মনের উৎপন্ন পদার্থ নয়। অনেকের ইচ্ছা! আমার মধ্যে ইচ্ছিত হয়ে ওঠে । মাড়োয়ারিদিগের মধ্যে অনেক লোকেই টাকাকে ইচ্ছা করে। মাড়োয়ারির ঘরে একটি ছোটাে ছেলেও টাকার ইচ্ছাকে পোষণ করে । কিন্তু এই ইচ্ছা কি তার একান্ত নিজের ইচ্ছা ? সে ছেলে কিছুমাত্র বিচার করে দেখে না। টাকা জিনিসটা কেন লোভনীয়। টাকার সাহায্যে যে ভালো খাবে, ভালো পরবে, সে-কথা তার মনেও নেই । কারণ, বস্তুতই টাকার লোভে সে ভালো খাওয়া পরা পরিত্যাগ করেছে। টাকার দ্বারা সে অন্য কোনো সুখকে চাচ্ছে না, অন্য সব সুখকে অবজ্ঞা করছে, সে টাকাকেই চাচ্ছে । এমনতরো একটা অহেতুক চাওয়া নিশিদিন মাড়োয়ারি ছেলের মনে প্রচণ্ড হয়ে আছে তার কারণ- এই ইচ্ছা তার একলার নয়, সকলে মিলেই তাকে ইচ্ছা করাচ্ছে, কোনোমতেই তার ইচ্ছাকে থামতে দিচ্ছে না । কোনো সমাজে যদি কোনো একটা নিরর্থক আচরণের বিশেষ গৌরব থাকে। তবে অনেক লোককেই দেখা যাবে সেই আচারের জন্য তারা নিজের সুখসুবিধা পরিত্যাগ করে তাতেই নিযুক্ত আছে। দশজনে এইটে আকাঙক্ষণ করে এই হচ্ছে ওর জোর, আর কোনো তাৎপর্য নেই । যে-দেশে অনেক লোকেই দেশকে খুব বড়ো জিনিস বলে জানে সে-দেশে বালকেও দেশের জন্যে প্ৰাণ দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে । অন্য দেশে এই দেশানুরাগের উপযোগিতা উপকারিতা সম্বন্ধে যতই আলোচনা হােক-না, তবু দেশহিতের আকাঙক্ষা সত্য হয়ে মনের মধ্যে জেগে ওঠে না। কারণ, দশের ইচ্ছা প্রত্যেকের ইচ্ছাকে জন্ম দিচ্ছে না, পালন করছে না । বিশ্বপিতার সঙ্গে পুত্ররূপে আমাদের মিলন হবে, রাজচক্রবর্তী হওয়ার চেয়েও এটা বড়ো ইচ্ছা। কিন্তু এতবড়ো ইচ্ছাকেও অহরহ সত্য করে জাগিয়ে রাখা কঠিন হয়েছে। এইজন্যেই। আমার চারি দিকের লোক এই ইচ্ছােটা আমার মধ্যে করছে না । এর চেয়ে ঢ়ের যৎসামান্য, এমন-কি, ঢ়ের অর্থহীন ইচ্ছাকেও তারা আমার মনে সত্য করে তুলেছে এবং তাকে কোনোমতে নিবে যেতে দিচ্ছে না। এখানে আমাকে একলাই ইচ্ছা করতে হবে। এই একটি মহৎ ইচ্ছাকে আমার নিজের মধ্যেই আমার নিজের শক্তিতেই সার্থক করে রাখতে হবে। দশজনের কাছে আনুকূল্য প্রত্যাশা করলে হতাশ হব | শুধু তাই নয়, শত সহস্ৰ ক্ষুদ্র অর্থকে, কৃত্রিম অর্থকে, সংসারের লোক রাত্রিদিন আমার কাছে অত্যন্ত বড়ো করে সত্য করে রেখেছে। সেই ইচ্ছগুলিকে শিশুকাল হতে একেবারে আমার সংস্কারগত করে রেখেছে। তারা কেবলই আমার মনকে টানছে, আমার চেষ্টাকে কাড়ছে। বুদ্ধিতে যদি বা বুঝি তারা তুচ্ছ এবং নিরর্থক কিন্তু দশের ইচ্ছাকে ঠেলতে পারি নে।