পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন ዓOዓ মুখস্থ করে পরীক্ষা পাস করে ফুটবল খেলে এতবড় একটা জীবনকে নিঃশেষ করে দেবে ? কখনোই না- এ হতে পারে না। এই যুগের ধর্ম তোমাদের প্রাণকে স্পর্শকরুক। তপস্যার দ্বারা সুন্দর হয়ে তোমরা ফুটে ওঠে। আশ্রমবাস তোমাদের সার্থক হােক। তোমরা যদি মনুষ্যত্বের সাধনাকে প্রাণপণ করে ধরে না রাখ, শুধু খেলাধুলা পড়াশুনার ভিতর দিয়েই যদি জীবনকে চালিয়ে দাও, তবে যে তোমাদের অপরাধ হবে, তার আর মার্জন নেই- কারণ, তোমরা আশ্রমবাসী। আবার বলি, তোমরা কোন কালে এই পৃথিবীতে এসেছ, ভালো করে সেই কালের বিষয় ভেবে দেখো। বর্তমানকালের একটি সুবিধা এই বিশ্বের মধ্যে যে চাঞ্চল উঠেছে একই সময়ে সকল দেশের লোক তা অনুভব করছে। পূর্বে একস্থানে তরঙ্গ উঠলে অন্য স্থানের লোকেরা তার কোনােই খবর পেত না | প্রত্যেক দেশটি স্বতন্ত্র ছিল। এক দেশের খবর অন্য দেশে গিয়ে পীেছোবার উপায় ছিল না। এখন আর সে দিন নেই। দেশের কোনো স্থানে ঘা লেগে তরঙ্গ উঠলে সেই তরঙ্গ শুধু দেশের মধ্যে না, সমস্ত পৃথিবীর ভিতর দিয়ে তীরের মতো ছুটে চলে। আমরা সকলে এক হয়ে দাঁড়াই। কত দিক হতে আমরা বল পাই, সত্যকে আঁকড়ে ধরবার যে মহা নির্যাতন তাকে অনায়াসেই সহ্য করতে পারি, নানা দিক হতে দৃষ্টান্ত ও সমবেদনা এসে জোর দেয়-এ কি কম কথা। নিজেকে অসহায় বলে মনে করি না। এই তো মহা সুযোগ। এমন দিনে আশ্রমবাসের সুযোগকে হারিয়াে না। জীবন যদি তোমাদের ব্যর্থ হয়, আশ্রমের কিছুই আসে যায় না— ক্ষতি তোমাদেরই। গাছ ভরে বউল আসে। সকল বউলেই যে ফল হয় এমন নয়। কত ঝরে পড়ে, শুকিয়ে যায়, তবু ফলের অভাব হয় না। ডাল ভরে ফল ফলে ওঠে। ফল হল না বলে গছ দুঃখ করে না, দুঃখ বরাবউলের, তারা যে ফলে পরিণত হয়ে উঠতে পারল না। 畿 এই আশ্রম যখন প্রস্তুত হতেছিল, বৃক্ষগুলি যখন ধীরে ধীরে আলোর দিকে মাথা তুলে ধরছিল, তখনাে নূতন যুগের কোনােই সংবাদ এসে পৃথিবীতে পীেছােয় নি। অজ্ঞাতসারেই আশ্রমের ঋষি এই যুগের জন্য আশ্রমের রচনাকার্যে নিযুক্ত ছিলেন ; তখনাে বিশ্বমন্দিরের দ্বার উদঘাটিত হয় নি, শঙ্খ ধ্বনিত হয়ে ওঠেনি। বিংশ শতাব্দীর জন্য বিশ্বদেবতা গোপনে গোপনে কী যে এক বিপুল আয়োজন করছিলেন, তার লেশমােত্রও আমরা জানতুম না। আজ সহসা মন্দিরের দ্বার উদঘাটিত হলআমাদের কী পরম সৌভাগ্য! আজি বিশ্বদেবতাকে দর্শন করতেই হবে, অন্ধ হয়ে ফিরে গেলে কিছুতেই চলবে না। আজ প্রকাণ্ড উৎসব; এই উৎসব একদিনের নয়, দুদিনের নয়-শতাব্দীব্যাপী উৎসব। এই উৎসব কোনো বিশেষ স্থানের নয়, কোনো বিশেষ জাতির নয়। এই উৎসব সমগ্র মানবজাতির জগৎ-জোড়া উৎসব। এসে আমরা সকলে একত্র হইবাহির হয়ে পড়ি। দেশে কোনাে রাজার যখন আগমন হয়, তাকে দেখবার জন্য যখন পথে বাহির হয়ে আসি, তখন মলিন জীর্ণ বস্ত্রকে ত্যাগ করতে হয়, তখন নবীন বস্ত্ৰে দেহকে সজ্জিত করি। আজ, দেশের রাজা নন, সমগ্র জগতের রাজা এসে সম্মুখে দাঁড়িয়েছেন। নত করে উদ্ধত মস্তক। দূর করে সমস্ত বর্ষের সঞ্চিত আবর্জনা। মনকে শুভ্র করে তোলে। শান্ত হও, পবিত্র হও। তার চরণে প্ৰণাম করে গৃহে ফেরো। তিনি তোমাদের শিরে আশীৰ্বাদ ঢেলে দিন- মঙ্গল করুন, মঙ্গল করুন, মঙ্গল করুন।