পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AS by ի՝ রবীন্দ্র-রচনাবলী করতে পারে নি। সুরটিকে চিনতে এবং কণ্ঠটিকে সত্য করে তুলতে তারা উপযুক্ত গুরুর কাছে বহুদিন সংযমসাধন করতে প্ৰস্তুত হয়েছিল । এই ব্ৰহ্মচর্য আশ্রমটি প্ৰভাতের মতো সরল, নির্মল, স্নিগ্ধ। মুক্ত আকাশের তলে, বনের ছায়ায়, নির্মল স্রোতস্বিনীর তীরে তার আশ্ৰয় | জননীর কোল এবং জননীর দুই বাহু বক্ষই যেমন নগ্ন শিশুর আবরণ, এই আশ্রমে তেমনি নগ্নভাবে অবারিতভাবে সাধক বিরাটের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে থাকেন, ভোগবিলাস ঐশ্বৰ্য-উপকরণ খ্যাতি-প্রতিপত্তির কোনো ব্যবধান থাকে না । এ একেবারে সেই গোড়ায় গিয়ে শাস্তের সঙ্গে, মঙ্গলের সঙ্গে, একের সঙ্গে গায়ে গায়ে সংলগ্ন হয়ে বসা— কোনো প্ৰমত্ততা, কোনো বিকৃতি সেখান থেকে তাকে বিক্ষিপ্ত করতে না পারে এই হচ্ছে সাধনা | তার পরে গৃহস্থাশ্রমের কত কাজকর্ম, অর্জন ব্যয়, লাভ ক্ষতি, কত বিচ্ছেদ ও মিলন। কিন্তু এই বিক্ষিপ্ততাই চরম নয়। এরই মধ্যে দিয়ে যত দূর যাবার গিয়ে আবার ফিরতে হবে। ঘর যখন ভরে গেছে, ভাণ্ডার যখন পূর্ণ, তখন তারই মধ্যে আবদ্ধ হয়ে বসলে চলবে না। আবার প্রশস্ত পথে বেরিয়ে পড়তে হবে- আবার সেই মুক্ত আকাশ, সেই বনের ছায়া, সেই ধনহীন উপকরণহীন জীবনযাত্ৰা । নাই আভরণ, নাই আবরণ, নাই কোনো বাহ্য আয়োজন। আবার সেই বিশুদ্ধ সুরটিতে পৌছোনো, সেই সমে এসে শান্ত হওয়া । যেখান থেকে আরম্ভ সেইখানেই প্ৰত্যাবর্তন- কিন্তু এই ফিরে আসাটি মাঝখানের কর্মের ভিতর দিয়ে, বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়ে, গভীরতা লাভ করে । যাত্রা করার সময়ে গ্ৰহণ করার সাধনা আর ফেরবার সময়ে আপনাকে দান করার সাধনা | উপনিষৎ বলছেন আনন্দ হতেই সমস্ত জীবের জন্ম, আনন্দের মধ্যে সকলের জীবনযাত্রা এবং সেই আনন্দের মধ্যেই আবার সকলের প্রত্যাবর্তন । বিশ্বজগতে এই যে আনন্দসমুদ্রে কেবলই তরঙ্গলীলা চলছে, প্রত্যেক মানুষের জীবনটিকে এরই ছন্দে মিলিয়ে নেওয়া হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। প্রথমেই এই উপলব্ধি তাকে পেতে হবে যে, সেই অনন্ত আনন্দ হতেই সে জেগে উঠছে, আনন্দ হতেই তার যাত্রারম্ভ, তার পরে কর্মের বেগে সে যত দূর পর্যন্তই উদ্ভূিত হয়ে উঠুক-না, এই অনুভূতিটিই যেন সে রক্ষা করে যে, সেই অনন্ত আনন্দসমুদ্রেই তার লীলা চলছে— তার পরে কর্ম সমাধা করে আবার যেন সে অতি সহজেই নত হয়ে সেই আনন্দসমুদ্রের মধ্যেই আপনার সমস্ত বিক্ষেপকে প্রশান্ত করে দেয় । এই হচ্ছে যথার্থ জীবন । এই জীবনের সঙ্গেই সমস্ত জগতের মিল । সেই মিলেই শান্তি এবং মঙ্গল এবং সৌন্দর্য প্ৰকাশ পায় । হে চিত্ত, এই মিলটিকেই চাও। প্রবৃত্তির বেগে সমস্তকে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না । সকলের চেয়ে বড়ো হব, সকলের চেয়ে কৃতকার্য হয়ে উঠব এইটােকেই তোমার জীবনের মূল তত্ত্ব বলে জেনো না । এ পথে অনেকে অনেক পেয়েছে, অনেক সঞ্চয় করেছে, প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে তা আমি জানি, তবু বলছি এ পথ তোমার না হােক। তুমি প্রেমে নত হতে চাও, নত হয়ে একেবারে সেইখানে গিয়ে তোমার মাথা ঠেকুক যেখানে জগতের ছােটাে বড়ো সকলেই এসে মিলেছে। তুমি তোমার স্বাতন্ত্র্যাকে প্রত্যহই তীর মধ্যে বিসর্জন করে তাকে সার্থক করো। যতই উচু হয়ে উঠবে ততই নত হয়ে তার মধ্যে আত্মসমৰ্পণ করতে থাকবে, যতই বাড়বে ততই ত্যাগ করবে, এই তোমার সাধনা হােক | ফিরে এসো ফিরে এসো বার বার তার মধ্যে ফিরে ফিরে এসো- দিনের মধ্যে মাঝে মাঝে ফিরে এসো সেই অনন্তে । তুমি ফিরে আসবে বলেই এমন করে সমস্ত সাজানো রয়েছে। কত কথা, কত গোলমাল, বাইরের দিকে কত টানাটানি, সব ভুল হয়ে যায়, কোনো কিছুর পরিমাণ ঠিক থাকে না এবং সেই অসত্যের ক্ষেত্রে প্রবৃত্তির মধ্যে বিকৃতি এসে পড়ে। প্রতিদিন মুহুর্তে মুহুর্তে এইরকম ঘটছে, তারই মাঝখানে সতর্ক হও, টেনে আনো আপনাকে, ফিরে এসো, আবার ফিরে এসো, সেই গোড়ায়, সেই শাস্তের মধ্যে মঙ্গলের মধ্যে, সেই একের মধ্যে । কাজ করতে করতে কাজের মধ্যে একেবারে হারিয়ে যেয়ে না, তারই মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে এসো তীর কাছে ; আমোদ করতে করতে আমাদের মধ্যে একেবারে নিরুদেশ হয়ে যেয়ে না, তারই মাঝে মাঝে ফিরে ফিরে এসো যেখানে সেই তীর কিনারা | শিশু খেলতে খেলতে মার কাছে বার বার ফিরে আসে, সেই ফিরে আসার যোগ যদি একেবারেই