পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন । १२७ আবার আমাদের ধ্যানের মন্ত্রেরও সেই একই লক্ষ্য — তাকে সমস্তর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা, আমাদের দেশে বুদ্ধ এসেও বলে গিয়েছেন— যা-কিছু উর্ধে আছে অধােতে আছে, দূরে আছে নিকটে আছে, গোচরে আছে অগোচরে আছে, সমস্তের প্রতিই বাধাহীন হিংসাহীন শক্রতাহীন অপরিমিত মানস এবং মৈত্রী রক্ষা করবে। যখন দাড়িয়ে আছ বা চলছ, বসে আছ বা শুয়ে আছ, যে পর্যন্ত না নিদ্ৰা আসে সে পর্যন্ত এই প্রকার স্মৃতিতে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকাকেই বলে ব্ৰহ্মবিহার । অর্থাৎ ব্রহ্মের যে ভাব সেই ভাবটির মধ্যে প্রবেশ করাই হচ্ছে ব্ৰহ্মবিহার । ব্ৰহ্মের সেই ভাবটি কী ? যশ্চােয়মস্মিন্নাকাশে তেজোময়োহুমূতময়ঃ পুরুষঃ সৰ্বানুভূঃ- যে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ সর্বানুভূ হয়ে আছেন তিনিই ব্ৰহ্ম। সর্বানুভু, অর্থাৎ সমস্তই তিনিই অনুভব করছেন এই তীর ভাব । তিনি যে কেবল সমস্তর মধ্যে ব্যাপ্ত তা নয়, সমস্তই তীর অনুভূতির মধ্যে। শিশুকে মা যে বেষ্টন করে থাকেন সে কেবল তীর বাহু দিয়ে তার শরীর দিয়ে নয়, তার অনুভূতি দিয়ে। সেইটেই হচ্ছে মাতার ভাব, সেই তার মাতৃত্ব । শিশুকে মা আদ্যোপােন্ত অত্যন্ত প্রগাঢ় রূপে অনুভব করেন । তেমনি সেই অমৃতময় পুরুষের অনুভূতি সমস্ত আকাশকে পূর্ণ করে সমস্ত জগৎকে সর্বত্র নিরতিশয় আচ্ছন্ন করে আছে । সমস্ত শরীরে মনে আমরা তীর অনুভূতির মধ্যে মগ্ন হয়ে রয়েছি। অনুভূতি, অনুভূতি— তার অনুভূতির ভিতর দিয়ে বহু যোজন ক্রোশ দূর হতে সূর্য পৃথিবীকে টানছে, তারই অনুভূতির মধ্য দিয়ে আলোকতরঙ্গ লোক হতে লোকান্তরে তরঙ্গিত হয়ে চলেছে। আকাশে কোথাও তার বিচ্ছেদ নেই, কালে কোথাও তার বিরাম নেই | শুধু আকাশে নয়— যশ্চােয়মস্মিন্নাত্মনি তেজোময়ােহমুতময়ঃ পুরুষঃ সৰ্বানুভূঃ— এই আত্মাতেও তিনি সর্বানুভূ। যে আকাশ ব্যাপ্তির রাজ্য সেখানে তিনি সর্বানুভূ, যে আত্মা সমাপ্তির রাজ্য সেখানেও তিনি সর্বানুভূ । ا তা হলেই দেখা যাচ্ছে যদি সেই সর্বানুভুকে পেতে চাই তা হলে অনুভূতির সঙ্গে অনুভূতি মেলাতে হবে । বস্তুত মানুষের যতই উন্নতি হচ্ছে ততই তার এই অনুভূতির বিস্তার ঘটছে। তার কাব্য দর্শন বিজ্ঞান কলাবিদ্যা ধর্ম সমস্তই কেবল মানুষের অনুভূতিকে বৃহৎ হতে বৃহত্তর করে তুলছে। এমনি করে অনুভূ হয়েই মানুষ বড়ো হয়ে উঠছে, প্ৰভু হয়ে নয়। মানুষ যতই অনুভু হবে প্রভুত্বের বাসনা ততই তার খর্ব হতে থাকবে। জায়গা জুড়ে থেকে মানুষ অধিকার করে না, বাহিরের ব্যবহারের দ্বারাও মানুষের অধিকার নয়— যে পর্যন্ত মানুষের অনুভূতি সেই পর্যন্তই সে সত্য, সেই পর্যন্তই তার অধিকার । ভারতবর্ষ এই সাধনার পরেই সকলের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল— এই বিশ্ববােধ, সর্বানুভূতি । গায়ত্রীমন্ত্রে এই বােধকেই ভারতবর্ষ প্রত্যহ ধ্যানের দ্বারা চর্চা করেছে, এই বােধের উদবােধনের জন্যেই উপনিষৎ সর্বভূতকে আত্মীয় ও আত্মাকে সর্বভূতে উপলব্ধি করে ঘূণাপরিহারের উপদেশ দিয়েছেন এবং বুদ্ধদেব এই বােধকেই সম্পূর্ণ করবার জন্যে সেই প্রণালী অবলম্বন করতে বলেছেন যাতে মানুষের মন অহিংসা থেকে দয়ায়, দয়া থেকে মৈত্রীতে সর্বত্র প্রসারিত হয়ে যায়। এই-যে সমস্তকে পাওয়া, সমস্তকে অনুভব করা, এর একটি মূল্য দিতে হয়। কিছু না দিয়ে পাওয়া যায় না। এই সকলের চেয়ে বড়ো পাওয়ার মূল্য কী ? আপনাকে দেওয়া। আপনাকে দিলে তবে সমস্তকে পাওয়া যায়। আপনার গীেরবই তাই— আপনাকে ত্যাগ করলে সমস্তকে লাভ করা যায়, এইটেই তার মূল্য, এইজন্যই সে আছে। তাই উপনিষদে একটি সংকেত আছে— তাক্তেন ভুঞ্জ থাঃ,ত্যাগের দ্বারাই লাভ করে, ভোগ করো। মা গৃধঃ, লোভ কোরো না । বুদ্ধদেবের যে শিক্ষা সেও বাসনাবর্জনের শিক্ষা ; গীতাতেও বলছে— ফলের আকাঙক্ষা ত্যাগ করে নিরাসক্ত হয়ে কাজ করবে। এই সকল উপদেশ হতেই অনেকে মনে করেন ভারতবর্ষ জগৎকে মিথ্যা বলে কল্পনা করে বলেই এই প্রকার উদাসীনতার প্রচার করেছে। কিন্তু কথাটা ঠিক এর উলটাে।