পাতা:রমেশ রচনাবলী (উপন্যাস).djvu/৪৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমাজ সংসার চালান ভার হইয়া উঠিল। গ্রামস্থ দয়াদ লোকে কিছু কিছু সহায়তা করিলেন, এবং বিন্দ যখন কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আইসেন, তখন মিত্রপরিবারের যথেষ্ট সাহায্য করিলেন। মিত্রদিগের জমাজমী যাহা ছিল, তাহা ভাগে বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন, পরিবারের খাইবার জন্য মধ্যে মধ্যে চাউল ডাল, তরিতরকারি পাঠাইতেন, বর্ষাকালে তাহাদের বাড়ীর উঠানে কতকগুলি বেগনে গাছ ও নানা প্রকার শবজি রোপণ করিয়া দিতেন, এবং শীতকালে ছেলেদের জন্য গরম জামা স্বহস্তে সেলাই করিয়া দিতেন। সব্বদা দেখিতে যাইতেন, এবং শিশু গোপবালা সব্বদা বিন্দর বাড়ী খেলা করিতে আসিত। গোকুলচন্দ্র গ্রামের বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিত, কিন্তু পিতৃবিয়োগবশতঃ এখন অধ্যয়ন ত্যাগ করিল, কায্যের চেটা দেখিতে লাগিল। ১৬ বৎসরের অশিক্ষিত বালকের কি কাজ মিলিবে ? কিন্তু ছেলেটী বড় বৃদ্ধিমান, ৮ টাকা ১০ টাকার বকশীগিরি বা সরকারি করিয়া কিছয় টাকা করিল, এবং এখন রাস্তা পথের কন্ট্রাক্ট লইয়া বিশেষ উপাজন করিতে আরম্ভ করিল। মাকে ও ভগিনীকে বড় কিছল পাঠাইত না; গোকুল বুদ্ধিমান, টাকা জমাইতে জানে। তালপুকুরে গোকুলের মা ও ভগিনী জমী হইতে সামান্য আয় পাইয়া, এবং বিন্দর সাহায্যে কোনও প্রকারে সংসার চালাইত। বিন্দর কন্যা সুশীলার বয়স যখন সাত বৎসর, গোপবালার বয়স তখন নয় বৎসর, সতরাং দুই জনে সব্বদাই একত্র বিন্দর উঠানে খেলা করিত। সুশীলা শ্যামবর্ণা ও বড় ভাল মানুষ, চক্ষ দটী মার মত সন্দের ও বিশাল, কিন্তু মেয়েটী বিশেষ সন্দেরী নহে। গোপবালা বড় ধারাল মেয়ে, বড় সেয়ানা, বড় সন্দেরী। মুখখানি সৌন্দয্যে ও বৃদ্ধির লক্ষণে বিভূষিত, রং যেন কাঁচা সোণা, ভ্রলেতা যেন তুলি দিয়া অাঁকা, চক্ষ দুইটী কি উক্তজবল, কি তীক্ষা! তালপুকুর গ্রামের মধ্যে এরুপ ফটফটে মেয়ে আর ছিল না, গ্রামের বিস্তীর্ণ বাগানে বা বক্ষচ্ছায়ায় মেয়েটি যখন ছুটোছটি করিয়া খেলা করিত, বোধ হয় যেন কোন দেবকন্যা নন্দনকাননে বিচরণ করিতেছে। কৃষকগণ মাঠে যাইবার সময় মেয়েটিকে দেখিলে ফিরে চাহিত, ঘাট থেকে মেয়েরা জল আনিবার সময় কলস নামাইয়া একবার মেয়েটিকে কোলে লইত। গোপবালা যেমন সন্দেরী, তেমনি সেয়ানা। নয় বৎসরের মেয়ের যে পেটে পেটে বুদ্ধি, তাহা দেখিয়া গ্রামের বয়স্কাগণ বিস্মিত হইতেন। একলা ভাবিত, একলা মতলব স্থির করিত, একলা গোপনে সম্পাদন করিত। সুশীলার সহিত খেলা করিত, কিন্তু সুশীলা হাবা মেয়ে, গোপবালার মন কি বুঝিবে ? সুশীলাকে তুষ্ট করিয়া তাহার খেলার সামগ্রীগুলি একে একে সংগ্ৰহ করিত, বিন্দ ও সন্ধাকে মা বলিত, ও কখন একটী খেলনা, কখন মিস্টান্ন, কখন একখানি ঢাকাই কাপড় সংগ্রহ করত। বিন্দ বলিতেন, “আহা মেয়েটা কি শাস্ত, কি নম্র, কি সুধীর । দেখিলে চক্ষ জড়ায়।” মল্লিকবাড়ী হইতে গোপবালার মার নিকট ঘটকী আসিল। গোপীর মা গালি দিয়া বলিলেন, —বলিস কি পোড়ারমুখী, আমার মেয়েকে জলে ভাসাইয়া দিব ? ৫০ বৎসরের বড়োর সঙ্গে আমার কচিমেয়ের বিয়ে দিব ? টাকা নিয়ে কি মেয়ে ধয়ে খাবে, গয়না নিয়ে কি মেয়ে পেতে শোবে ? হইলাম বা আমরা গরিব, আমরা গরিবই থাকিব, টাকা নিয়ে মেয়েকে বিক্রয় করিব না। ও মা, ছি! ছিঃ! ছি! বলি বড়ো যে আমার গোপীর ঠাকুন্দার বয়সী—বাছা উমার যদি ছেলে থাকিত, সে যে আজ প্রায় গোপীর বয়সী হইত, বিন্দর মেয়ে যে প্রায় আমার গোপীর বয়সী-- আর সেই বিন্দর জ্যেঠা, উমার বাপ, সে কি না আমার গোপীকে বিয়ে করিতে চায় ? বলি যম কি বড়োদের ভুলে থাকে লো? আর বড়োগুলোই বা কি গা ? নাতিনী বয়সী ফটফটে মেয়ে দেখেও মুখ দিয়ে নাল পড়ে ? ছিঃ! ছি! আমন বড়োর মাখে আগন। না গো না, অমন কথাটি মুখে এনো না—ঐ কালীর মা এক বড়োর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল, কি হইল দেখিলে ত? আবার সেই রকম কাজ করে ? না গো না, আমার তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে, যাঁর ধন, যাঁর সংসার, তিনি আমাকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছেন—আমিও গেলেই বাঁচি আর এ যন্ত্রণা সহ্য হয় না,—বিধবা স্বামীকে সমরণ করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। ঘটকী ফিরিয়া গেল, বালিকা গোপবালা বেড়ার বাহিরে দাঁড়াইয়া সকল কথাগুলি শুনিল । মনে মনে বলিল, “আমি বড় ঘরের বেী হব, তাতে মা আপত্তি করিতেছেন। মার আপত্তি খাটিবে না।” Ç তারিণীবাব মতলব স্থির করিলে সহজে হাটবার লোক নহেন। পরদিন ঘটকী বিন্দর 8○>