যাত্রার পূর্ব্বে তাহার পিতামাতার নিকট বিদায় লইবার জন্য সে পত্নীকে পিতৃগৃহে লইয়া গেল। হেমাঙ্গিনী মাতঙ্গিনীর অত্যন্ত স্নেহের পাত্রী ছিল—ভাগ্যচক্রে হউক অথবা যে কারণেই হউক, ঠিক এই সময়ে রাজমোহনের স্ত্রী মাতঙ্গিনী ও পিতৃগৃহে উপস্থিত ছিল।
শ্বশুরালয়ে বেশিদিন থাকিবার ইচ্ছা মাধবের ছিল না। পিতামাতা ও ভগ্নীর নিকট হইতে অনির্দ্দিষ্ট কালের জন্য বিচ্ছিন্ন হইবার আশঙ্কায় হেমাঙ্গিনী খালি কাঁদিত। তাহার মনে হইত সে দূরে—বহুদূরে চলিয়া যাইতেছে এবং হয়তো কখনও বাল্যের স্নেহস্মৃতিসম্বলিত পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিবে না। তাহার পিতামাতা কি কখনও তাহাকে দেখিতে যাইবেন? বাবা বলিয়াছেন, তিনি যাইবেন। কিন্তু মা? দিদি? মা ও দিদি উত্তর দেয় নাই, নীরবে কাঁদিয়াছিল? তাহাকে আশীর্ব্বাদ করিয়াছিল।
মাতঙ্গিনী একদিন ভগিনীর হাত ধরিয়া তাহাকে এক পাশে লইয়া গিয়া বলিল, হেম, তোকে একটা কথা বলব, রাখবি? হেমাঙ্গিনী জবাব না দিয়া ডাগর কালো চোখের বিস্মিত আয়ত দৃষ্টি মেলিয়া দিদির দিকে চাহিল।
মাতঙ্গিনী আবার বলিল, হেম, কালকে আমাদের ছাড়াছাড়ি হবে, নয়? হেমাঙ্গিনী আর থাকিতে পারিল না, ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। মাতঙ্গিনী নিজে বহুকষ্টে কান্না সামলাইয়া বলিল, কাঁদিস নে বোন, কাঁদিস নে। ভগবান তোর মঙ্গল করবেন। মাধবের মত স্বামী পেয়েছিস, সে তোকে অসুখী করবে না —এই কথা বলিতে বলিতে তাহার চোখে অশ্রুর বান ডাকিল; গাল ছাপাইয়া ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হেমাঙ্গিনীর পদ্মের মত শুভ্র হাতের উপর পড়িল। হাতখানি মাতঙ্গিনীর হাতে ধরা ছিল।
চোখ মুছিয়া হেমাঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কিছু বলছিলে দিদি?