তাহার নিজের পদধ্বনিও তাহার হৃদয়কে ভয়চকিত করিয়া তুলিতেছিল। তথাপি সে বুক বাঁধিয়া চলিতে লাগিল, মনে মনে সহস্র বার ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করে—কখনও বা অর্দ্ধোচ্চারিত মন্ত্র পড়িতে থাকে। দুই উচ্চ ভূমিখণ্ডের মধ্যবর্ত্তী সমতল পথের উপরেই অন্ধকার নিবিড়তম; একদিকে ঘন কাঁটাগুল্মের বেড়াঘেরা বৃহৎ আম্রবন, অন্যদিকে একটি পুকুরের উঁচু পাড়—ছোট ছোট গুল্মে নিবিড়ভাবে আচ্ছাদিত এবং ইহাদিগকে ছাইয়া তিনটি বটগাছের পত্রাচ্ছাদিত বৃহৎ শাখা আন্দোলিত হইতেছে। নিম্নের ছায়াচ্ছন্ন পথ বটগাছের জন্য আরও অন্ধকার দেখাইতেছে। মাতঙ্গিনী সভয়ে চক্ষু ফিরাইল, আম্রবনের মধ্য হইতে একটা তীব্র আলোকরশ্মি আসিতেছিল এবং অশান্ত চাপাকণ্ঠের আওয়াজও যেন শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। সে যাহা ভয় করিতেছিল তাহাই বুঝি শেষ পর্য্যন্ত ঘটিয়া যায়! এই তো সেই ডাকাতের দল। মাতঙ্গিনী চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল—এক পা চলিতে পারিল না। বিপদের উপর বিপদ, পথশায়িত একটি কুকুর নিশীথ রাত্রের পথিকের পদশব্দে জাগরিত হইয়া উচ্চৈস্বরে চীৎকার শুরু করিল। অমনই আমবাগান হইতে আগত কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হইল। এইটুকু বুঝিতে পারিবার মত প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব মাতঙ্গিনীর তখনও ছিল যে, দস্যুরা কুকুরের ইঙ্গিত অবজ্ঞা করে নাই এবং তাহারা ধরা পড়িতে বিলম্ব হইবে না। নূতন বিপদের আশঙ্কায় সে যেন শক্তি ফিরিয়া পাইল। হরিণের মত নিঃশব্দ চঞ্চল চরণে সে পুকুরের অন্ধকার পাড়ের দিকে ধাবমান হইয়া দ্রুত জলের ধারে পৌঁছিল। পায়ে-চলার পথে যাহারা তাহাকে খুঁজিবে, পুকুরের খাড়া পাড় তাহাদের দৃষ্টিপথ হইতে তাহাকে আড়াল করিল বটে, কিন্তু দস্যুরা যদি যে পাড়ে বটগাছগুলি ছিল সেই পাড়ে আসিয়া তাহার খোঁজ করে, তাহা হইলে আর রক্ষা নাই। কাছাকাছি ঝোপঝাড়ও ছিল না যে, সে লুকাইয়া বাঁচিবে। কিন্তু মাতঙ্গিনী তখন সাহস সঞ্চয় করিয়াছে—সে কালবিলম্ব করিল না।
পাতা:রাজমোহনের স্ত্রী.djvu/৫০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪২
রাজমোহনের স্ত্রী