কুকুরটা তখনও ঘেউ ঘেউ করিতেছিল। মাতঙ্গিনী চক্ষের নিমিষে জলের ধার হইতে খানিকটা ভারী কাদা তুলিয়া লইয়া গায়ের মোটা চাদরে তাহা বাঁধিয়া ফেলিল। এইভাবে আসন্ন বিপদের হাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিবার জন্য সে প্রস্তুত হইয়া রহিল, ভাবিল, সূক্ষ্ম পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলাইয়া লইতে বেশি বেগ পাইতে হইবে না। পুকুরের অন্য পাড়ে পদশব্দ স্পষ্ট শোনা যাইতে লাগিল—চাপা কণ্ঠস্বর কানে আসিল। সে ধীরে ধীরে চাদরের পুঁটলিটি জলে ডুবাইল—জলে কোনও দ্রব্যপতনের শব্দমাত্র হইল না। তারপর বটগাছের ছায়া যেখানে ঘন হইয়া পড়িয়াছিল এমন একটা জায়গা বাছিয়া সে নিজেও জলে ডুব দিল। নিজের নাসিকার প্রান্তভাগ পর্য্যন্ত নিমজ্জিত করিয়া বসিয়া রহিল—কালো জলে বটগাছের কালো ছায়ায় যদি দেখিবার সম্ভাবনাও থাকিত, তাহা হইলে তাহার মাথা ছাড়া আর কিছু দেখিবার উপায় রহিল না। তবুও পাছে তাহার কমলের মত মুখের গৌরবর্ণ তাহাকে বিপদে ফেলে, সে খোপা খুলিয়া ফেলিয়া আলুলায়িত কৃষ্ণ কেশদাম মুখের চারিদিকে ছড়াইয়া দিল—খুব নিবিষ্ট দৃষ্টিও এখন আর কালো জলের সঙ্গে সেই কালো কেশের পার্থক্য ধরিতে পারিবে না।
দেখিতে দেখিতে পদশব্দ ও কণ্ঠস্বর পুকুরের সেই পাড়ে আসিয়া মাঝপথে থামিল। মাতঙ্গিনী শুনিল, কিন্তু মাথা নাড়িল না।
একজন বলিল, তাজ্জব ব্যাপার, আমি যে ঝোপের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখলাম রাস্তায় আপাদমস্তক চাদর মোড়া একটা মূর্ত্তি দাঁড়িয়ে আছে।
অন্য একজন বলিল, না হে না, তুমি গাছকে মানুষ ঠাউরে থাকবে— মানুষ হ’লে এর মধ্যেই হাওয়া হয়ে গেল কি ক’রে? তা ছাড়া এই দারুণ গ্রীষ্মে অমন চাদরমুড়ি দিয়ে মাথা খারাপ না হ’লে তো কেউ বের হবে না।
জবাব শোনা গেল, “ঠিক বলেছ দাদা, হয়তো অপদেবতাই একটা দেখে থাকব।”