প্রকাশ করেন নাই। নক্ষত্ররায় যে সৈন্যসামন্ত লইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিতে আসিয়াছেন, সে কথার উল্লেখ মাত্র করেন নাই। উভয়ের মধ্যে পূর্বে যেমন ভাব ছিল, এখনও অবিকল যেন সেই ভাবই আছে। অথচ সমস্ত পত্রের মধ্যে একটি সুগভীর স্নেহ ও বিষাদ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে– তাহা কোনো স্পষ্ট কথায় ব্যক্ত হয় নাই বলিয়া নক্ষত্ররায়ের হৃদয়ে অধিক আঘাত লাগিল।
চিঠি পড়িতে পড়িতে অল্পে অল্পে তাঁহার মুখভাবের পরিবর্তন হইতে লাগিল। হৃদয়ের পাষাণ-আবরণ দেখিতে দেখিতে ফাটিয়া গেল। চিঠি তাঁহার কম্পমান হাতে কাঁপিতে লাগিল। সে চিঠি লইয়া কিয়ৎক্ষণ মাথায় ধারণ করিয়া রাখিলেন। সে চিঠির মধ্যে ভ্রাতার যে আশীর্বাদ ছিল তাহা যেন শীতল নির্ঝরের মতো তাঁহার তপ্ত হৃদয়ে ঝরিয়া পড়িতে লাগিল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত স্থির হইয়া সুদূর পশ্চিমে সন্ধ্যারাগরক্ত শ্যামল বনভূমির দিকে অনিমেষ নেত্রে চাহিয়া রহিলেন। চারি দিকে নিস্তব্ধ সন্ধ্যা অতলস্পর্শ শব্দহীন শান্ত সমুদ্রের মতো জাগিয়া রহিল। ক্রমে তাঁহার চক্ষে জল দেখা দিল, দ্রুতবেগে অশ্রু পড়িতে লাগিল। সহসা লজ্জায় ও অনুতাপে নক্ষত্ররায় দুই হাতে মুখ প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরিলেন। কাঁদিয়া বলিলেন, “আমি এ রাজ্য চাই না। দাদা, আমার সমস্ত অপরাধ মার্জনা করিয়া আমাকে তোমার পদতলে স্থান দাও, আমাকে তোমার কাছে রাখিয়া দাও, আমাকে দূরে তাড়াইয়া দিয়ো না।”
বিল্বন একটি কথাও বলিলেন না– আর্দ্র হৃদয়ে চুপ করিয়া বসিয়া দেখিতে লাগিলেন। অবশেষে নক্ষত্ররায় যখন প্রশান্ত হইলেন, তখন বিল্বন কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার পথ চাহিয়া গোবিন্দমাণিক্য বসিয়া আছেন আর বিলম্ব করিবেন না।”
নক্ষত্ররায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমাকে কি তিনি মাপ করিবেন?”
বিল্বন কহিলেন, “তিনি যুবরাজের প্রতি কিছুমাত্র রাগ করেন নাই।