শিশিরসিক্ত শুভ্র প্রাতঃকালে সেই আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন প্রভাতের মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল। রাজার কি মনে পড়িল যে, যে অদৃষ্ট আজ তাঁহাকে রাজ্যত্যাগী ও অপমানিত করিয়া গৃহ হইতে বিদায় করিয়া দিতেছে, সেই অদৃষ্ট এই ক্ষুদ্র কুটিরদ্বারে সেই আষাঢ়ের অন্ধকার প্রাতঃকালে তাঁহার জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল? এইখানেই তাহার সহিত সেই প্রথম সাক্ষাৎ। রাজা অন্যমনস্ক হইয়া এই কুটিরের সম্মুখে কিছুক্ষণ স্থির হইয়া রহিলেন। তাঁহার অনুচরগণ ছাড়া তখন পথে আর কেহ লোক ছিল না। জুমিয়ার নিকট তাড়া খাইয়া ছেলেগুলো পালাইয়াছে, কিন্তু জুমিয়া দূরবর্তী হইতেই আবার তাহারা আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহাদের চীৎকারে চেতনালাভ করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া রাজা আবার ধীরে ধীরে চলিতে লাগিলেন।
সহসা বালকদিগের চীৎকারের মধ্যে একটি সুমিষ্ট পরিচিত কণ্ঠ তাঁহার কানে আসিয়া প্রবেশ করিল। দেখিলেন, ছোটো ধ্রুব তাহার ছোটো ছোটো পা ফেলিয়া দুই হাত তুলিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহার কাছে ছুটিয়া আসিতেছে। কেদারেশ্বর নূতন রাজাকে আগেভাগে সম্মান প্রদর্শন করিতে গিয়াছে, কুটিরে কেবল ধ্রুব এবং এক বৃদ্ধা পরিচারিকা ছিল। গোবিন্দমাণিক্য ঘোড়া থামাইয়া ঘোড়া হইতে নামিয়া পড়িলেন। ধ্রুব ছুটিয়া খিল্খিল্ করিয়া হাসিয়া একেবারে তাঁহার উপরে ঝাঁপাইয়া পড়িল; ধ্রুব তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিয়া, তাঁহার হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজিয়া, তাহার প্রথম আনন্দের উচ্ছ্বাস অবসান হইলে পর, গম্ভীর হইয়া রাজাকে বলিল, “আমি টক্টক্ চ’ব।”
রাজা তাহাকে ঘোড়ায় চড়াইয়া দিলেন। ঘোড়ার উপর চড়িয়া সে রাজার গলা জড়াইয়া ধরিল, এবং তাহার কোমল কপোলখানি রাজার কপোলের উপরে নিবিষ্ট করিয়া রহিল। ধ্রুব তাহার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে রাজার মধ্যে কী একটা পরিবর্তন অনুভব করিতে লাগিল।